নারী নির্যাতন রোধে সমাজের ভূমিকা
বিশ্বের উন্নত, অনুন্নত, দুর্নীতিমুক্ত, শিক্ষিত, গণতান্ত্রিক, বিচারব্যবস্থা ও আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত দেশেও প্রকাশ্যে কিংবা সবার অগোচরে নিরবে নিভৃতে পুরুষ কর্তৃক নৃশংস অথবা মৃদুভাবে নারী নির্যাতন হয়ে আসছে সেই আদিকাল থেকে।
বাংলাদেশে আমাদের সমাজেও নারীরা প্রতি পদে পদে নিগৃহীত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত, ঘৃণিত, অত্যাচারিত, অপমানিত হচ্ছে। আর এর জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কে দায়ী করা হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। আমরা যতই নারী ও পুরুষের সমঅধিকার, নারীর মর্যাদা, নারীর সম্মানকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলি না কেনো সারা পৃথিবীব্যাপী কমবেশি পুরুষের অগ্রাধিকারকে বেশী প্রাধান্য দেওয়ার অদৃশ্য ও অলিখিত মানসিকতা প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যায়।
আর এখানেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার জন্ম দেওয়া হচ্ছে বলে প্রতীয়মান ও পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বব্যাপী নারী ও পুরুষের অবাধ স্বাধীনতা সহ সহাবস্থান ও সমঅধিকার হয়তোবা উন্নয়নশীল দেশে আছে তারপরও নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে দোষারোপের যুক্তিসঙ্গত বেশিরভাগ আঙ্গুল পুরুষের দিকেই তোলা হয়ে থাকে। যার অসংখ্য নজির প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করছে বিশ্ববাসী।
গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় আমাদের দেশ অনেক পিছিয়ে আছে, যেখানে নেই ন্যূনতম গণতন্ত্রের চর্চা, নেই আইনের শাসন, ক্ষুধা ও চিকিৎসা বিহীন অনিশ্চয়তার জীবন, শিক্ষিতের হার অনেক কম, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে, জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শুধু পরাজিতই হচ্ছে না হারিয়ে ফেলছে জীবনের স্বাভাবিকতা, মানবিকতা, মনুষ্যত্ববোধ।
জীর্ণশীর্ণ রোগাক্রান্ত দেহ থেকে জীবনী শক্তিটুকুও যখন শেষ পর্যায়ে উপনীত তখন ঐ রোগাক্রান্ত দেহ মনে বাসা বাঁধে ব্যর্থতা, জীবনের প্রতি অনিশ্চয়তা ও বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছেটুকুও হারিয়ে ফেলে তখনই বিদ্রোহী হয়ে উঠছে ম-ম হৃদয় খানা, জীবন সংগ্রামে পরাজিত সৈনিক পাহাড়সম আর্তনাদ বুকে চেপে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পশুত্ববোধে অন্ধ আচরণে স্ত্রী সন্তান সহ পরিবারের কেউই রক্ষা পাচ্ছে না বাড়ির কর্তা পুরুষের অত্যাচারের হাত থেকে।
আমরা সর্বদাই দর্শকের ভুমিকায় অবতীর্ণ থেকে শুধুই লক্ষ্য করি আবার কখনো তীব্রভাবে সমালোচনাও করি, আবার কখনো লোকদেখানো প্রতিবাদ করি কিন্তু আমরা শুধুই দেখি ঐ পুরুষের বাহিরের নৃশংস রূপ কিন্তু ঘটনার পেছনের ঘটনা জানার চেষ্টা কখনোই করি না, খতিয়ে দেখি না কেনো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো।
নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা অনেক বেশি এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এক্ষেত্রে কোনোই বিতর্ক নেই উক্ত বিষয়ে, তবে অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যথেষ্ট দায়ী। কিছু কিছু নারী নিজেরাই নানান অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে, যার ভয়াবহতা ও নৃশংসতা কখনো কখনো পুরুষকেও হার মানায়, যার ফলে বিতর্কিত ও কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে নিজেদের কারণেই শিকার হচ্ছে সমাজে নানামুখী মুখরোচক অপবাদ ও ঘৃণার, যা কখনোই কাম্য হতে পারে না।
সাম্প্রতিককালে শুরু হওয়া নারীর স্বাধীনতা ও সমঅধিকারের নামে চলছে স্বেচ্ছাচারিতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, ও কুরুচিপূর্ণ পোশাক পরিধানের মাধ্যমে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করার জঘন্য প্রতিযোগিতা। আধুনিকতা মানেই অশ্লীলতা নয় আবার আধুনিকতার বিপক্ষেও নয় অথচ এই বাঙালি জাতির আধুনিকতার মাঝেই রয়েছে নর নারীর প্রকৃত সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব ও রুচিশীলতার অপরূপ বহিঃপ্রকাশ।
এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য মুষ্টিমেয় কিছু নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে উপরোক্ত কথাগুলো প্রযোজ্য যারা কথায় কথায় নারীবাদী হয়ে পুরুষ পরিধান করছে নারীর পোশাক কপালে টিপ হাতে চুড়ি আর নারীরা অবাধ স্বাধীনতার নামে হচ্ছে প্রায় উলঙ্গ।
আরও পড়ুনপুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষেরা নারীকে ভোগের সামগ্রী, অবলা, নিরীহ, নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে নারী নির্যাতন, মিথ্যা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে কথায় কথায় নারীকে মিথ্যা দোষারোপ, নিজের আধিপত্য বিস্তার ঘটাতে যেয়ে নারীর প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ মানসিকতা স্তিমিত করে দেয় সভ্য সমাজের মানুষদের কে। নারী মায়ের জাতি, নারী বোনের জাতি, নারী সহধর্মিণী ও পরিশেষে নারী কন্যা সন্তানের জাতি।
মহান আল্লাহ তায়ালা সমগ্র মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে বেশী নারী জাতিকে সম্মানিত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা কে ছাড়া যদি কাউকে সিজদাহ্ করার অনুমতি দিতেন তাহলে সেটা মা কে দিতেন। এতো উপরে নারীর স্থান হওয়া সত্ত্বেও কেনো নারী আজ নির্যাতিত, অবহেলিত, অপমানিত। প্রশ্নটা যতো সহজ কিন্তু এর উত্তর অতো সহজ নয় বলেই নারী নির্যাতন নিয়ে এখনো সোচ্চার নারীবাদী সংগঠন সহ বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন মানুষ।
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে পুরুষ ও নারী সমাজ যতোই প্রতিবাদ করুক না কেনো কোনোই লাভ হবে না যতদিন না পর্যন্ত নিজের মানসিকতা কে আমরা পরিবর্তন করতে না পারবো। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে, সভা সেমিনারে, পত্র পত্রিকায়, টেলিভিশনের বিভিন্ন আলোচনা সভায় নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করে বাড়ি ফিরে নিজের পরিবারের নারী ও গৃহপরিচারিকার প্রতি অমানবিক আচরণের কথা হরহামেশাই শোনা যায়।
অনেক পরিবারই আছে যেথায় সবার অলক্ষ্যে চলছে শাশুড়ী কর্তৃক পুত্রবধূর উপর নির্মম আচরণ আবার পুত্রবধূ কর্তৃক শ্বশুর শাশুড়ীর উপর অকথ্য আচরণ। এমন অসংখ্য নজির ঘরে ঘরে ঘটছে যা আমরা জেনেও না জানার ভান করছি, আবার আমরাই অন্যের দিকে আঙ্গুল তাক করে অপরাধীর তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করছি। কেনো এমন দ্বৈত আচরণ, কেনো এই মানসিকতা, কেনো নারী পুরুষ উভয়কেই যথাযোগ্য প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।
ধর্মীয় অনুশাসন মেনে, অশ্লীলতাকে পরিহার করে সবার হৃদয়ে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধকে জাগ্রত করতে হবে। শুধু মুখে নয় বাস্তবেও তার প্রতিফলন ঘটিয়ে, নিজের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে পারলে অবশ্যই দূর হবে নারীর প্রতি সহিংসতা, চিরতরে বন্ধ হবে নারীর প্রতি অমানবিক আচরণ সব ধরনের নারী নির্যাতন।
লেখক : প্রাবন্ধিক
01711-884898
মন্তব্য করুন