কুষ্টিয়ায় মিলনকে যেভাবে হত্যার পর টুকরা করা হয়
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: কুষ্টিয়ায় কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের দাবি করা চাঁদা না দেয়ায় মিলন হোসেনকে হত্যা করা হয়। গত রোববার বিকেলে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদা সুলতানার আদালতে এ মামলার চার আসামি স্বীকারোক্তি দেন। আদালতে জবানবন্দিতে হত্যার বর্ণনা দেন তারা।
গ্রেফতার আসামিদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফোন করে মিলনকে অফিসে ডেকে নেন তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার সজল। সেখানে আগে থেকে সজিবসহ কয়েকজন অবস্থান নিয়েছিলেন। অফিসে যাওয়ার পর মিলনের কাছে চাঁদা দাবি করেন সজিব। ভয়ভীতি দেখাতে তাঁকে মারধর করেন। একপর্যায়ে মুখে গামছা গুঁজে নাক চেপে ধরেন। ঘটনাচক্রে মিলন মারা যান।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, মিলনকে হত্যার সময় ওই অফিসের দুটি কক্ষে সজিবসহ অন্তত ১০ থেকে ১১ জন ছিলেন। সেখানে দুটি কক্ষে তাঁরা অবস্থান নেন। লাশ গুম করতে সজিব পরিকল্পনার কথা তাদের জানান। এ সময় একজনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি অফিসে তালা লাগিয়ে বাইরে চলে যান। বাকিরা ঘরের ভেতর থাকেন। দেড় ঘণ্টা ধরে শহরের তিনটি দোকান থেকে লাশ কাটার জন্য হেক্সা ব্লেড, পলিথিন ব্যাগ ও রক্ত পরিষ্কারের জন্য জীবাণুনাশক কেনেন। বিকেল ৫টার দিকে আবারও অফিসে ফিরে আসেন। পরে দুর্বলচিত্তের ৪-৫ জনকে পাশের কক্ষে রাখেন। সজিবসহ ৪-৫ জন মিলে একটি কক্ষের বাথরুমে লাশ নিয়ে টুকরা করেন। প্রায় ৪ ঘণ্টা ধরে লাশ কেটে তাঁরা ব্যাগে ভরেন।
পুলিশ জানায়, রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাঁরা চারটি মোটরসাইকেলে সাত জন ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে আসেন। বাকিদের সজিব যে যার মতো বাড়ি চলে যেতে বলেন এবং বিষয়টি কাউকে না জানাতে হুমকি দেন।
পুলিশ শহরের কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। তাতে দেখা গেছে, রাত ৯টা ৩২ মিনিটের দিকে চারটি মোটরসাইকেলে সাত জন শহরের ছয়রাস্তা মোড় হয়ে হরিপুর সেতু দিয়ে পদ্মার চরের দিকে চলে যান। রাত ১১টার মধ্যে লাশের টুকরাগুলো পদ্মার চরে বালুচাপা দিয়ে যে যাঁর মতো বাড়ি চলে আসেন। সবাই স্বাভাবিকভাবে শহরে চলাফেলা করতে থাকেন। কেউ পালানোর চেষ্টা করেননি। কল পেয়ে শহরের ভাড়া বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন মিলন। নিখোঁজের পর সন্ধ্যায় মিলনের স্ত্রী মিমি কুষ্টিয়া মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর মোবাইলের কল লিস্টের সূত্র ধরে সাবেক ছাত্রলীগের নেতা এসকে সজিবসহ ৫ জনকে আটক করে পুলিশ।
আরও পড়ুনথানায় জিডির পর থেকে লাশ উদ্ধার ও জড়িতদের ধরার অভিযানে নেতৃত্ব দেন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পলাশ কান্তি নাথ। পুলিশের এই কর্মকর্তাসহ আরও ২-৩ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে ঘটনার বিস্তারিত জানা যায়।
জিডির সূত্র ধরে সজলকে থানায় ডেকে নেয় পুলিশ। এরপর তাঁকে উপর্যুপরি জিজ্ঞাসাবাদ চলে। কিন্তু বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) সারা দিনেও তিনি কোনো তথ্য দেননি। শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) সকালে সজল থানায় তাঁর এক পরিচিত পুলিশ সদস্যকে মিলনকে হত্যার কথা জানান। এরপর বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানতে পারেন। পরে অভিযান চালিয়ে চার ঘণ্টার মধ্যে সজিবসহ আরও চারজনকে শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। সজিবকে আটকের পর তাঁর ফোনে বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন নেতা ফোন করেন। তখন ফোনটি পুলিশের হেফাজতে ছিল। আটক ব্যক্তিরা মিলনকে হত্যার কথা অস্বীকার করতে থাকেন। শুক্রবার রাতে সজিব কান্না করতে করতে একপর্যায়ে সব ঘটনা পুলিশকে জানান। ভোররাতে লাশের টুকরা উদ্ধারে যান অন্তত ৫০ জন পুলিশ সদস্য। লাশ গুমের পর লাশ টুকরা করতে ব্যবহৃত যন্ত্র বাধবাজার এলাকায় একটি পুকুরে এবং মিলনের ব্যবহৃত মোবাইল জঙ্গলে ফেলে দেন তাঁরা। সেই ফোন এখনও উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
পুলিশ জানায়, হত্যায় জড়িত ব্যক্তিরা সবাই একে অপরের পরিচিত। মিলন হাউজিং এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। একই এলাকায় আরেকটি বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে অফিস হিসেবে অনলাইনে কাজ করতেন।
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পলাশ কান্তি নাথ বলেন, এ পর্যন্ত ঘটনায় জড়িত ১৩-১৪ জনের নাম পাওয়া গেছে। অধিকতর যাচাই-বাছাই চলছে। সব আসামিকে ধরা হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
মন্তব্য করুন