বাঙালির ঐতিহ্য : শীতের পিঠা
প্রাচীনকালে পিঠাকে মিষ্টান্নের মধ্যেই ধরা হতো। ‘পিঠা’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘পিষ্টক’ শব্দ থেকে। আবার ‘পিষ্টক’ এসেছে ‘পিষ’ ক্রিয়ামূলে তৈরি হওয়া শব্দ ‘পিষ্ট’ থেকে। পিষ্ট অর্থ চূর্ণিত, মর্দিত, দলিত। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষ বইয়ে লিখেছেন, পিঠা হলো চালের গুঁড়া, ডাল বাটা, গুড়, নারিকেল ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি মিষ্টান্নবিশেষ।
বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান। ধান থেকে চাল হয় এবং সেই চালের গুঁড়া পিঠা তৈরির মূল উপকরণ। ভারতীয় সভ্যতার প্রেক্ষাপটে বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে পিঠা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার নির্দিষ্ট কোনো বিবরণ নেই, তবে সংস্কৃত সাহিত্যে ‘পিষ্টক’ শব্দটির উল্লেখ মেলে।
বাংলা ভাষায় লেখা কৃত্তিবাসী, রামায়ণ, অন্নদামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চৈতন্য চরিতামৃত ইত্যাদি কাব্য এবং মৈমনসিংহ গীতিকার কাজলরেখা গল্পকথনের সূত্র ধরে আনুমানিক পাঁচশ বছর আগেও বাঙালি খাদ্য সংস্কৃতিতে পিঠার জনপ্রিয়তার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। সুতরাং বুঝায় যায় যে, বাংলার পিঠা তৈরির ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো।
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে পিঠা তৈরি হয়ে আসছে। সেই সময় বাংলার কৃষিপ্রধান সমাজে ধান ছিল প্রধান খাদ্যশস্য। ষড়ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। শীতকাল এগুলোর অন্যতম ঋতু। শীতকালে নতুন ধান ওঠে। সেই ধানে ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর উৎসব শুরু হয়। নতুন চালের গুঁড়া আর খেজুর রসের গুড় দিয়ে বানানো হয় নানা রকম পিঠা।
এগুলোর নানা রকম নাম, আবার নানা রকম রূপের বাহার। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পুলি পিঠা, দুধপুলি ও পাটিসাপটা বেশ জনপ্রিয়।
এ ছাড়া তালের পিঠা, কলা পিঠা, নকশি পিঠা, পাকান পিঠা, কুশলি, তেলে ভাজা পিঠা, পায়েস পিঠা, সেমাই কুলি পিঠা, শামুক পিঠা, গোলাপ পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, পাকড়া পিঠা, ডিমের ঝাল পিঠা, মালপোয়া, মালাই পিঠা, বিবিখানা, দুধচিতই, চষি পিঠা, ক্ষীরকুলি, দুধে ভিজানো হাতকুলি ছাড়াও হরেক রকম পিঠা তৈরি হয় বাংলার ঘরে ঘরে।
বাংলাদেশে কত শত রকমের পিঠা যে তৈরি হয় তার সুনির্দিষ্ট কোন তালিকা আজও করা সম্ভব হয়নি। প্রত্যেক বছর বাংলাদেশ শিশু একাডেমি জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে পিঠা মেলার আয়োজন করে থাকে যেখানে শতাধিক পিঠা প্রদর্শিত হয়।
পায়েস, ক্ষীর ইত্যাদি মুখরোচক খাবার গুলোও আমাদের রসনাকে তৃপ্ত করে শীতকালে। এ সময় শহর থেকে অনেকেই গ্রামে যায় পিঠা খেতে। তখন গ্রামের বাড়িগুলো নতুন অতিথিদের আগমনে মুখর হয়ে ওঠে।
পিঠা ছাড়া শীতকালে বাঙালির আতিথেয়তাও যেন সম্পূর্ণ হয় না। শীত এলেই বাঙালির পারিবারিক রীতি অনুযায়ী মেয়ে-জামাতাকে দাওয়াত করে আনা হয়। যদিও এখন যান্ত্রিক ব্যস্ততার যুগে পরিবারের সবাই মিলে গ্রাম-বাংলার সেই রসাল পিঠা-পায়েস খাওয়ার উৎসবের রীতি অনেকটাই ম্লান হয়েছে। পানির বাষ্পে তৈরী ভাপের মধ্যে দানা গুড় গলে তৈরি হওয়া মিষ্টি মজাদার পিঠার নাম ভাপা পিঠা।
আরও পড়ুনএটি বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী পিঠা। সাধারণত শীত মৌসুমেই ঘরে ঘরে ভাপা পিঠা তৈরির ধুম পড়ে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতা ও দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মালদহে ভাপা পিঠা ভাক্কা পিঠা নামে পরিচিত। বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে এখন গোটা মালদহ শহরের বিভিন্ন রাস্তায় অসংখ্য দোকান তৈরি হয়েছে ভাক্কা পিঠার।
বাংলার পিঠার ইতিহাসের সাথে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, নবান্ন, পৌষসংক্রান্তি, চৈত্রসংক্রান্তি, বৈশাখী, ঈদ, শারদীয় দূর্গাপূজা ইত্যাদি উৎসবে পিঠা তৈরি ও খাওয়ার বহুল প্রচলন রয়েছে।
এই পিঠা তৈরি আর খাওয়া বাংলার মানুষ এমন এক উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে যা যুগে যুগে বাংলার কবি সাহিত্যিকের কলমে বারবার উঠে এসেছে। পিঠাকে ঘিরে ‘পল্লী মায়ের কোল’ কবিতায় বিখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশীতে বিষম খেয়ে / আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।’ বর্তমানে দেশের প্রায় সকল শহরের অলিতে গলিতে, রাস্তার মোড়ে, শীতকালে ভাপা ও চিতই পিঠা বানিয়ে বিক্রি করা হয়।
এক শ্রেণির মৌসুমি পিঠা বিক্রেতা শীতকালে পিঠা তৈরীর এ ব্যবসা করে থাকেন। এ ছাড়া অনেক বড় বড় হোটেলে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘পিঠা উৎসব’ বা ‘পিঠার মেলা’ আয়োজন করা হয়। বড় হোটেলগুলোতে হোম ডেলিভারির সুবিধা থাকায় গ্রাহকরা ঘরে বসেই পাচ্ছেন বাহারি রকম পিঠার স্বাদ।
পিঠা বাঙালি সংস্কৃতির একটি অন্যতম উপাদান। পৌষ-পার্বণ তথা পিঠা-পার্বণের এ আনন্দ ও ঐতিহ্য যুগ যুগ টিকে থাকুক বাংলার ঘরে ঘরে। শিল্প-বিপ্লবের যুগে শহরের মায়েরা পিঠা বানানো ভুলে গেলেও গ্রামের মায়েরা কিন্তু এত দ্রুত ভুলে যাননি। তাঁরাই বাঁচিয়ে রাখবেন বাংলার পিঠাকে যুগ হতে যুগান্তরে।
লেখক : শিক্ষক, মিলেনিয়াম স্কলাস্টিক স্কুল এন্ড কলেজ,
জাহাঙ্গীরাবাদ সেনানিবাস, বগুড়া।
hubari1976@gmail.com
01716103858
মন্তব্য করুন