বই পড়া-তথ্য প্রযুক্তি এবং তরুণ প্রজন্মে
বই না পড়ার কারণে অধিকাংশ নতুন প্রজন্ম অন্ত:সারশূন্য হয়ে বেড়ে উঠছে। দেহকে বাঁচাতে গেলে যেমন খাদ্যের প্রয়োজন তেমনি আত্মার খাদ্য বই। কেননা বই একমাত্র প্রকৃত বন্ধু। এ প্রস্েঙ্গ বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী তার বইকেনা প্রবন্ধে বলেেেছন, রুটি, মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার দুটি চোখ কালো হবে, কিন্তু বই অনন্ত যৌবনা।” তাই তরুণ প্রজন্মকে অবশ্যই ভাবতে হবে বই পড়া নিয়ে। শুধু মেলায় বই কিনলেই হবে না বই পড়তেও হবে।
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত। তাদের সে অম্লান স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রতিবছর ১লা ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক মাসব্যাপী অমর ২১শে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। গত ১লা ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বই মেলার উদ্বোধন করেন। বই মেলার ৪০তম বছরে এবারেও গতবারের মত প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, “পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ”।
আধুনিক অসাম্প্রদায়িক চেতনার উর্বর উৎস বই মেলাকে আরো বিকশিত করা প্রাণবন্ত করার জন্য প্রয়োজন গল্প উপন্যাসের পাশাপাশি ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন ভিত্তিক গ্রন্থ যা সমাজকে আলোকিত করবে এবং বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ তৈরি করবে আজকে তথ্য প্রযুক্তির যুগে তরুণ প্রজন্মকে। ১৯৭২ সালে মুক্তধারা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একা বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৬ সালে অন্যান্যরা অনুপ্রাণিত হন। কিন্তু তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে এর কোনো নাম ছিল না। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সস্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি।
পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিকে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু সে বছর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কারণে বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। তবে ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে বইমেলার সুচনা হয়।
একুশে বই মেলার লক্ষ্য উদ্দেশ্য বহুমাত্রিক। নবীন প্রবীণ লেখকদের বিভিন্ন বই নানা ধরনের পাঠক পাঠিকা তাদের মনের রুচি অনুযায়ী ক্রয় করে। অনেক পাঠক আছে যারা বই মেলা থেকে একাধিক বই ক্রয় করে। প্রকৃত পক্ষে বই মেলা যেন হাজারও পাঠকের মিলন মেলা। বই মানুষের মনকে ভালো রাখে। সুস্থ রাখে। বই মানুষের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু। মানুষ মানুষের সাথে বিশ্বসাঘাতকতা করে কিন্তু বই বিশ্বসাঘাতকতা করে না। ছলনা বোঝেনা।
বই শুধু মানুষকে নিয়ে যায় এক গভীর জ্ঞানের রাজ্যে। যেখানে শুধু শান্তি আর প্রশান্তি। ১৯৬৭ সাল থেকে বই মেলার সাথে এ ভূখন্ডের মানুষের আত্মার সম্পর্ক। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, একুশে গ্রন্থ মেলা থেকে বই ক্রয় করা এক ধরনের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। কারণ সে বই কেউ পড়ে, কেউ পড়েনা। তাছাড়া আজকের যুগে বই পড়তে ভালো লাগে না।
তার পরিবর্তে মোবাইল ইন্টারনেট ল্যাপটপ তো রয়েছে। প্রকৃত বাস্তবতা হলো সেকালের মত একালে শিক্ষার্থীরা বই পড়তে চায় না। তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের যুগে বইয়ের পরিবর্তে ইন্টারনেট ফেসবুকে আসক্তি বাড়ছে। অথচ একুশে বই মেলার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে নতুন প্রজন্ম বা পাঠক সমাজে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করা।
কবিগুরু বলেছেন, ‘একটি পাঠ্যবইকে হজম করতে হলে অপাঠ্য বইয়ের দরকার। কিন্তু এ দরকার মানেই বেশি করে বই পড়া। শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বই পড়ার পাশাপাশি অপাঠ্য বই পড়ার উৎসাহ তৈরি করা যাতে করে শিক্ষার্থীদের মেধামনন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়ে। অথচ বই পড়া বা সাহিত্যচর্চা ছাড়া যে জ্ঞানী হওয়া যায় না সেটা আজকের প্রজন্ম প্রায় ভুলেই গেছে।
বই মানুষের মনকে সহজ, সরল, সজাগ, শুম্ভ্র করে, কালিমা মুুক্ত করে, পুত-পবিত্র করে, একজন মানুষকে সত্যিকার অর্থে সৎ, নিষ্ঠাবান ও আদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থী, নতুন প্রজন্ম, শিক্ষিত ছেলে মেয়ে বই পড়ার পরিবর্তে ইন্টারনেট, ফেসবুক, সোস্যাল মিডিয়া তথা তথ্য প্রযুক্তির নানা দিক নিয়ে ব্যস্ত। যদিও প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য। তথ্য প্রযুক্তির এ উৎকর্ষের যুগে নতুন প্রজন্ম জ্ঞানের দিকে মঙ্গলের দিকে ধাবিত হওয়া দরকার।
বই মেলার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে পাঠক সৃষ্টি, বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা ও সৃজনশীলতা। বই মানুষকে যেমন মহৎ করে তেমনি জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হয়। গল্প, উপন্যাসসহ নানা ধরনের সৃজনশীল গ্রন্থ মানুষের মনকে করে প্রভাবিত ও বিকশিত। মনকে করে প্রফুল্ল। মনকে করে পরিবর্তন। সুকুমার বৃত্তিগুলোর উন্মেষ ঘটিয়ে মনকে করে সুন্দর। সকল প্রকার কু দৃষ্টি, কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্ত করে বই মানুষের মনকে জাগ্রত কর্।ে এক কথায় বলা যায় বই এক অফুরন্ত জ্ঞান ও আনন্দের উৎস।
আজকের যে তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, পৃথিবীর ইতিহাস ঐতিহ্যের অন্যতম অবলম্বন বই। বই মানুষের মনকে আনন্দিত করে না শিখায় সফলতার গল্প্। মানুষের মন হৃদয় চিন্তার জগতকে করে প্রসারিত। সে সময়ে মানুষ বইকে জীবনের নিত্য সঙ্গী হিসেবে বেঁচে নিয়ে ছিল । এখন শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর হাতে হাতে শোভা পাচ্ছে বইয়ের পরিবর্তে মোবাইল ল্যাপটপ।
জীবনে এগুলোর প্রয়োজন যে নেই তা বলছি না। কিন্তু এর বহুমাত্রিক ও নেতিবাচক ব্যবহারে আমাদের সমাজে নানা ধরনের অবক্ষয় ও অপরাধ বাড়ছে। স্বাধীনতার ‘৫২ বছরে বাংলাদেশ আর্থসামাজিক দিকে যতটা উন্নতি হয়েছে তার চেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে দেশের জ্ঞান- বিজ্ঞান ও তথ্য- প্রযুক্তি। প্রায় প্রতিটি ছেলেমেয়ে অবসর সময়ে বই পড়ার পরিবর্তে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। অথচ এক সময় আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ ছিল। ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল।
তারা বই পড়ার পাশাপাশি নানা ধরনের হাসি তামাশার গল্প বলে সময় কাটাত। অজানাকে জানার আগ্রহে তারা লাইব্রেরিতে গিয়ে ইতিহাস, বিজ্ঞান, বিভিন্ন মনীষীর জীবনীর বই পড়ত। এতে তারা এক দিকে নতুন কিছু জানত অন্যদিকে তাদের জ্ঞানার্জন ও জানার স্পৃহা বেড়ে যেত।
আরও পড়ুনসামাজিক শৃঙ্খলা মজবুত ছিল। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে নতুন প্রজন্মের অধিকাংশই বই পড়তে চায় না। কিন্তু যদি অধিকাংশ ছেলে-মেয়েই মনের রুচি অনুযায়ী বইমেলা থেকে বই ক্রয় করে পড়ে, তাহলে তাদের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা দূরীভূত হবে।
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করছে বলা যায়, প্রত্যেকের হাতে মোবাইল আছে। তাদের মধ্য অনেকেই কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও বই পড়তে চায় না। এভাবে আজকের তথ্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাল যুগের ছেলে- মেয়েরা লেখাপড়ায় ভালভাবে মনোনিবেশ করতে পারছে না। তাদের শুভ চিন্তা শক্তি ও সৃজনশীলতা অনেকাংশে লোপ পাচ্ছে। আজকের বাংলাদেশ শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতির সাথে অন্য দেশের সংস্কৃতির তফাৎ রয়েছে। আমাদের ভাষা আন্দোলন এনে দিয়েছে স্বাধীনতা। সে চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করে আজকের প্রজন্মকে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। আমাদের ভাষা সংস্কৃতি স্বকীয়তাকে ধারণ করে বাংলা ভাষায় রচিত বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ পড়তে হবে। জানতে হবে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
তাই আজকের প্রজন্মকে বেশিবেশি করে বই পড়া দরকার। লাইব্রেরি যেমন বইয়ের ভান্ডার, বই যেমন জ্ঞানের ভান্ডার তেমনি বইমেলাও। অথচ অবসর সময়ে বই পড়লে মানুষের অন্তরের কুপ্রবৃত্তি গুলো বিনাশ এবং মনকে করে আলোকিত। অতিসম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ মার্কিন সিনেটরদের কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়েছেন।
মার্কিন সিনেটে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়ার পর ফেসবুকের এই জনক সেই সব মা বাবা ও পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, ফেসবুক ও অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তির জন্য যাদের সন্তানদের ক্ষতি হয়েছে। তবে কি তথ্য প্রযুক্তির কারণে বই পড়ার আগ্রহ কমে যাচ্ছে? তবুও তথ্য প্রযুক্তির বিকল্পও নেই। তবে এর ব্যবহার হওয়া উচিত ইতিবাচক।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে যে বই মেলা উদযাপিত হচ্ছে এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিই প্রমাণ করে বইমেলার আবহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, মূল্যবোধ। জাতীয় চেতনাকে আমরা ভুলে যাই তাহলে উন্নয়ন, প্রগতিশীল বিশ্ব থেকে পিছিয়ে যাব। ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি একটি জাতির প্রাণশক্তি। তৎকালিন তরুণ ছাত্রসমাজ জীবন দিয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করেছে।
স্মৃতিকে অবশ্যই ধরে রাখতে হবে। স্মরণ করতে হবে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস। বইমেলা শুধু বইমেলাই নয়, তা বই পড়ার তাগিদও ছড়িয়ে দেয় পাঠক সমাজে তাই তরুণ প্রজন্মকে তাদের মন-মানসিকতা পরিবর্তন দরকার। তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার বই পড়ার আগ্রহকে নিরুৎসাহিত করছে এ চিন্তা ভাবনা থেকে তরুণ প্রজন্মকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজের মনকে সতেজ,সরাগ সমৃদ্ধ করতে তুলে নিতে হবে বই। বিচরণ করতে হবে জ্ঞানের রাজ্যে।
তথ্য প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি নিজে বই পড়তে হবে এবং অন্যকেও উৎসাহিত করা দরকার তরুণ প্রজন্মকে। তথ্য প্রযুক্তি ও বইপড়া এ দু’য়ের সমন্বয় ঘটিয়ে আজকের তরুণ প্রজন্মকে হতে হবে জাত মানুষ। বইপড়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে অর্জন করতে হবে মানবিক মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব। কারণ বর্তমান প্রজন্মই আগামী দিনের জাতির ভবিষৎ। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কারিগর।
যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন হয়েছিল এবং পরবর্তিতে প্রতিবছর ভাষা শহীদদের অম্লান স্মৃতি রক্ষার্থে ও পাঠক সমাজে বইপড়ার আগ্রহ বাড়ানোর জন্য বইমেলার আয়োজন করা হয়। কিস্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে বর্তমান প্রজন্ম আশানুরূপ বই পড়তে চায় না। তথ্য প্রযু্িক্তর ব্যাপক প্রসারের যুগে বই এর জানালা ও জ্ঞানের আলো বন্ধ করার কারণে নানা নেতিবাচক দিক আমাদের সমাজে প্রভাব ফেলছে।
অথচ বই মানুষকে মহৎ করে, আলোকিত করে। বর্তমান তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশের অধঃপতিত তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। বইমুখী হয়ে বইকে জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়ে সমাজে বই পড়ার আগ্রহ ও অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
লেখকঃ শিক্ষক ও কলামিস্ট
tnalichs@gmail.com
01719-536231
মন্তব্য করুন