যারা দিয়েছেন বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশকে
আমি মাত্র গত কয়েকদিন আগে আনিসুল হকের মা পড়লাম। বইটির নাম আমি এর আগে বহুবার শুনেছি। কিন্তু পড়ার ইচ্ছা জাগেনি। এর অন্যতম কারণ ম্যাক্সিম গোর্কির মা। এই বইটি অনেক আগেই পড়েছিলাম। দুইটা উপন্যাসের নাম একই রকম হওয়াতে কেমন যেন কপি কপি মনে হচ্ছিল। তাই বইটি পড়িনি। কিন্তু গত কয়েকদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখক আনিসুল হকের সাক্ষাৎকার দেখলাম।
তার লেখা মা বইটির ১১০তম মুদ্রণ বের হচ্ছে। প্রতি মুদ্রণে ১০ হাজার কপি ধরলে দাঁড়ায় প্রায় ১১ লাখ। যা রীতিমত বিস্ময়কর। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এর আগে কোন বই এতবার মুদ্রণ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যে কারণে বইটি সংগ্রহ করি এবং পড়ি। কিছুটা দ্রুতই পড়ি। কারণ ২০০৩ সালে প্রকাশিত একটি বই এখনো পড়া হয়নি, জানলে হয়তো অনেকেই হাসবেন।
সেই ভীতি থেকেই দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করি। দ্রুত শেষ করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কারণ কিছু কিছু জায়গা বার বার পড়েছি। ম্যাক্সিম গোর্কির মা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিলো। মার তেমন কোন পড়াশুনা নেই। শুধু এতটুকু বোঝেন কিসে সন্তানদের ভালো হয়। সেটা শুধু নিজের সন্তানের জন্য নয়, তার সন্তানের মত অন্য সন্তানদের জন্যও ছিলো একই ভাবনা।
সেই ভাবনায় তাকে মা’তে পরিণত করেছিলো। ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাস হলেও আনিসুল হকের মা ইতিহাস আশ্রিত সত্য ঘটনা অবলম্বনে উপন্যাস। যার উপাখ্যান নির্মিত হয়েছে সত্য ঘটনার বর্ণনায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রায়োগিক বর্ণনা একে আরো মোহনীয় করে তুলেছে। ৬০ এর দশকে একজন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মহিলার জীবন সংগ্রামের ইতিহাস উঠে এসেছে এতে।
যিনি ইচ্ছা করলেই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে পারতেন। স্বামীর ২য় বিবাহ মেনে নিয়ে রাজকীয় জীবন-যাপন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। আত্মসম্মান নিয়ে বেরিয়ে গেছেন বাড়ি থেকে। চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন একমাত্র ছেলে আজাদকে মানুষ করার। অতি কষ্টে তিনি সন্তানকে মানুষ করেছেন। এখন সুখের পালা। কিন্তু সামনে এসে দাঁড়ায় মুক্তিযুদ্ধ। দেশ ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম, যা বাংলাদেশের কোন মানুষ এড়িয়ে যেতে পারে না। পারেনি আজাদও।
স্নাতক পড়ার সময় পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের নগ্নরূপ প্রত্যক্ষ করেছে সে। মায়ের আদেশেই তাকে করাচি যেতে হয়েছিলো। কী নিদারুন বঞ্চনার শিকার হচ্ছিলো বাঙালি শিক্ষার্থীরা তা চোখে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস হতো না। আর এ ভাবনায় তাকে মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত করেছিলো। যদিও সে ইন্ডিয়ান ট্রেনিং নেয়নি। যদিও সে কোন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলো না। তবে দেশ-মাতৃকার টানে সে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। আজাদের মত লক্ষ লক্ষ তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো যুদ্ধে।
কেউ সন্তান হারিয়েছে, কেউ বাবা-মা হারিয়েছে, কেউ হারিয়েছে বন্ধু। তবু দেশটাকে বাঁচাতে হবে। লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়ে বাঁচিয়েছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন মাঝে মাঝেই লেখক পরিচিতি পড়তে গিয়ে দেখি লেখকের জন্ম কত সালে। ধীরে ধীরে লেখকদের জন্মের সাল আমাদের জন্মের কাছাকাছি এসে যাচ্ছে। যেমন আনিসুল হকের জন্ম ১৯৬৫ সালে। আমার জন্ম ১৯৮২ সালে। আগে ছোটবেলায় পড়তাম লেখকের জন্ম ১৯২০ সালে, ৩০ সালে অথবা ৪০ সালে।
এখন তো আমাদের জন্মের কাছাকাছি এসে গেছে। হয়তো আজ থেকে ২০ বছর পর শুনবো বিখ্যাত লেখকদের জন্ম ১৯৮০ অথবা ৮২ সালে। অর্থাৎ আমরা এগিয়ে যাচ্ছি মৃত্যুর দিকে। পৃথিবীর অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবো সকলে। যেমন হারিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল অথবা জীবনানন্দ দাস। তবে তাদের সৃষ্টকর্ম আমাদের মাঝে রয়ে গেছে। তারা যা সম্মুখে দেখে লিখেছেন আমাদের তা কল্পনায় লিখতে হবে।
আরও পড়ুনঅথবা ভিন্ন লেখকের বইগুলি রেফারেন্স হিসেবে নিতে হবে। যেমন নিয়েছেন আনিসুল হক তার বইগুলিতে। হুমায়ূন আহমেদ যা দেখে লিখেছেন আনিসুল হক তা গবেষণায় জানছেন। আমরা এভাবেই গ্রহ-নক্ষত্রের মত একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। সময় আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে ৫২ এবং ৭১ থেকে দূরে। ভাষা সৈনিকরা হারিয়ে গেছেন আর মুক্তিযোদ্ধারা হারিয়ে যাচ্ছেন।
তবে রয়ে গেছে তাদের দেওয়া বাংলা ভাষা, রয়ে গেছে তাদের দেওয়া বাংলাদেশ। আনিসুল হকের পরিচিতিতেও লেখা গত বিংশ শতাব্দিতে জন্ম একজন লেখক। অর্থাৎ আমরা এখন আছি অন্য শতাব্দিতে। তেমনি ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ পড়ে রইলো অন্য শতাব্দিতে। এভাবেই আমরা চলছি এক শতাব্দি থেকে অন্য শতাব্দিতে, দূরে বহু দূরে। কিন্তু আজাদের মাকে কি মনে রাখবে সবাই? নাকি হারিয়ে যাবে কালের গহ্বরে। সন্তান হারা মায়ের যে সে কি নিদারুন যন্ত্রণা।
স্বামীর অপমানে প্রতিবাদী মায়ের একমাত্র অবলম্বন তার সন্তান যাকে তিনি হারিয়ে ফেলেছেন মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশ সৃষ্টিতে। হয়তো ইচ্ছে করলেই তাকে বাঁচাতে পারতেন। যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি না দিলেই সে বেঁচে যেতো। তিনি তো সকল সন্তানের কথা ভেবে তা করেননি। সন্তান পাক আর্মিদের কাছে ধরা পড়ার পর অসহনীয় নির্যাতনেও বন্ধুদের কথা বলতে মা নিষেধ করেছেন।
তিনি যে সকল সন্তানের মা। তাই তো একজনের জন্য তিনি তা বলতে পারেন না। আজাদের মৃত্যুর ১৪ বছর পর তার মা সন্তান হারানোর একই দিনে মারা গেছেন অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে। তবুও মাথা নোয়াননি। তার কথা কি সবাই মনে রাখবে? মনে রাখবে কি আজাদের কথা।
আজাদ চেয়েছিলো তার মায়ের আত্মত্যাগের কথা গোটা পৃথিবী জানুক। ম্যাক্সিম গোর্কির মার কথা সবাই মনে রেখেছে। কারণ রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের এই আত্মত্যাগ কী পুরোপুরি সফল হয়েছে।
এখনো কি আমরা সবাই ভাষা সৈনিকদের কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা যথাযথভাবে স্মরণ করি। আমরা কি সবাই স্মরণ করি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের, শহীদ আজাদ, শহীদ রুমি আর তাদের মা দের?
লেখক: যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক, বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ
সদস্য, যুব ও ক্রীড়া উপ কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
মন্তব্য করুন