সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা সুনিশ্চিত করা হোক
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে পঞ্চম শ্রেণি পাসকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২২ লাখ ৬০ হাজার। ছেলে ১১ লাখ ৪০ হাজার এবং মেয়ে ১১ লাখ ২০ হাজার। বাংলাদশে শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশষে তথ্যমতে, বর্তমানে ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সংখ্যা চার লাখ ৪১ হাজার ৬২০ জন।
উভয় শিক্ষা বোর্ড থেকে পাসকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পরিসংখ্যান এখনো প্রকাশিত হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ৯০% শিক্ষার্থী ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। এখনো ১০% শিক্ষার্থী নতুন শিক্ষানীতির কারণে ভর্তি হতে পারেনি। বাস্তবে ঝরে পড়া শিশু শিক্ষার্থীর হার আরও বেশি হবে। গ্রামীণ এলাকায় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার হার শহর এলাকার তুলনায় কম।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে পিএসসি পরীক্ষায় ২৭,৭৭,২৭০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। ছাত্র সংখ্যা ১২,৭৮,৭৪২ জন এবং ছাত্রীর সংখ্যা ১৪, ৯৮,৫২৮ জন। আর ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ৩, ১৭, ৮৫৩ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। পিএসসি পরীক্ষায় পাশের হার ৯৮ দশমিক ৫২ শতাংশ। এর কারণ গ্রামে বিদ্যালয়ের সংখ্যা কম, শিক্ষার মান ভালো নয়।
অনেক শিক্ষার্থীর পরিবারের সামর্থ্য নেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাহিরে পড়ানোর। নতুন শিক্ষা নীতির অধীনে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের অবশ্যই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮টি বর্ষ পাস করতে হবে।
২০০৮ সালে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল ৩৭ লাখের বেশি শিশু। তাদের মধ্যে ২৬ লাখের কিছু বেশি শিক্ষার্থী নিবন্ধন করেছে ২০১২ সালে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে। এই হিসাবে পঞ্চম শ্রেণীতে আসা পর্যন্ত ঝরে পড়েছে প্রায় সাড়ে ১১ লাখেরও বেশি খুদে শিক্ষার্থী।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের দেশে বইপত্র এমনভাবে তৈরি বা রচনা করা হয়েছে যা মোটেই শিশু শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। অনেক দেশে খেলার ছলে শিশুদের পড়ানো হয়। পড়ানো হয় গল্পের ছলেও। আমাদের দেশের পাঠ্যবইয়ের বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই নিরস লাগে। এনিয়ে অনেক সময় অভিভাবকরা মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র ও অতিদরিদ্র পরিবার থেকে আসে। তাদের মধ্যে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ শিশু চরম অপুষ্টির শিকার। ৫৫ শতাংশেরও বেশি স্বাভাবিকের তুলনায় কম ওজনের। অপুষ্টির কারণে পড়ার প্রতি তেমন মনোযোগীও হতে পারে না। এতে অনেকে স্কুল ত্যাগ করে। আরো অনেক কারণে স্কুল ত্যাগ করে শিক্ষার্থীরা। কি কারণে শিক্ষার্থীরা বেশি দিন বিদ্যালয়ে যায় না সেই কারণগুলো বের করে শক্তিশালী কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
অতিসম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানা যায় বগুড়ার আদমদীঘি রথবাড়ি এলাকার শাহিনুর আলমের কন্যা সানজিদা সান্তাহার হার্ভে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং আহসান উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করেছিল। কিন্তু লটারিতে নাম না উঠায় পছন্দের বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারায় তার মন খারাপ। একইভাবে পঞ্চগড় জেলার সীমান্তবর্তী তেঁতুলিয়া উপজেলায় কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থী এখনো বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়নি।
একদিকে সংসারে অভাব অনটন অন্যদিকে শিশুদের এলাকার কোন বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার জন্য ভর্তি করাতে না পেরে রীতিমত দুশ্চিন্তায় পড়েছে। সারা দেশের গ্রামের পর গ্রামে খোঁজ খবর নিলে এরকম অসংখ্য সানজিদার মত ছাত্র-ছাত্রীর পছন্দের বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারায় ঝরে পড়ার আশংকা রয়েছে। নতুন শিক্ষানীতি গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার ২০২২ সালে ঘোষণাকৃত শিক্ষানীতির অনেক ভালো দিক ও কিছু ত্রুটিপূর্ণ দিক আছে। ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলো হলো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের রুটিন খুব কঠোর। এই রুটিনে শিক্ষার্থীরা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায় না। ফলে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তাদের পড়াশোনার মনোযোগ কমে যায়। অনেক শিক্ষককে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। ফলে আধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষকরা ভালভাবে বুঝে উঠতে না পারায় শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারে না।
আরও পড়ুনআমি মনে করি, প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি কোঠা বাড়ানো। এছাড়া দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে বিদ্যালয়ের সংখ্যা কম এবং ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে শাখা চালু নাই সেগুলোতে নতুন করে শাখা খুলে ভর্তি বঞ্চিত শিশু শিক্ষার্থীদের পড়া-লেখার সুযোগ করে দেয়া। লটারি পদ্ধতি বাতিল করে এলাকার ছেলে-মেয়েদের বাড়ির ডালভাত খেয়ে পড়া-লেখার সুযোগ দেওয়া।
বর্তমান রুটিন শিক্ষার্থীদের জন্য খুব কঠিন। এই রুটিনে শিক্ষার্থীরা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায় না। এছাড়া শিক্ষকরাও সকাল থেকে শুরু করে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত প্রতিটি সেশনে টানা এক ঘন্টা ধরে রাখতে পারছে না। এক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী টানা ক্লাসের কারণে অস্বস্তিবোধ করছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের রুটিন ভারসাম্যপূর্ণ করতে হবে।
শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে। শিক্ষানীতিটিকে শিক্ষার্থীদের চাহিদা এবং বর্তমান বিশ্বের চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা সমাজে একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষার্থীরা তাদের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি বিকাশ করতে পারে। একটি টেকসই যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে যা বর্তমান এবং ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম।
শিক্ষার্থীদেরকে একটি দক্ষ এবং যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। টেকসই যুগোপযোগী শিক্ষানীতি চালু করার জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের সকল অংশীদারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য দূর করতে হবে। শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। এরকম পদক্ষেপগুলি বাস্তবায়ন করা হলে টেকসই যুগোপযোগী শিক্ষানীতি চালু করা সম্ভব হবে।
লেখক : উদ্যোক্তা, কবি ও সাংবাদিক
01718-281367
মন্তব্য করুন