বগুড়ায় প্রাথমিকে পাঁচ বছরে ঝরে পড়েছে অর্ধলক্ষাধিক শিক্ষার্থী
নাসিমা সুলতানা ছুটু : পাঁচ বছরে বগুড়ায় প্রাথমিকে ৫৬ হাজার ৩২৭ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। জেলায় ঝরে পড়ার হার ২৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এই তথ্য জানিয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝরে পড়েছে শিবগঞ্জ উপজেলায়। ওই উপজেলায় পাঁচ বছরে ঝরে পড়েছে ১৭ হাজার ৩৪৫জন।
এরপরই ঝরে পড়ার সংখ্যা বেশি ধুনট ও সোনাতলা উপজেলায়। ধুনটে পাঁচ বছরে ঝরে পড়েছে ১৪ হাজার ৪৩০ এবং সোনাতলা উপজেলায় ১৩ হাজার ২২০ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। অপরদিকে সবচে কম ঝরে পড়েছে বগুড়া সদর উপজেলায়। সদরে একই সময় মাত্র ২৭৯জন ঝরে পড়েছে।
এছাড়া আদমদীঘিতে ১ হাজার ৬১৩জন, কাহালুতে ৩৫০, দুপচাঁচিয়ায় ১ হাজার ৩৬৪, নন্দীগ্রামে ৫৬৭, শেরপুরে ৩৬৫, সারিয়াকান্দিতে ১ হাজার ১৫১ এবং শাজাহানপুরে ২ হাজার ৬৩৩জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী সবচে বেশি ঝরে পড়েছে করোনাকালীন দুই বছর। ২০২১ সালে ঝরে পড়েছে ১২ হাজার ১২১জন এবং ২০২০ সালে ঝরে পড়েছে ১১ হাজার ৪৬৩জন। ২০১৯ সালে ঝরেছে ১১হাজার ২৪৫, ২০২২ সালে ঝরে পড়েছে ১১ হাজার ৩৫৪ এবং ২০২৩ সালে ঝরে পড়েছে ১০ হাজার ১৪৪জন শিক্ষার্থী।
বগুড়া শহরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী রিমন গত চার মাস থেকে আর বিদ্যালয়ে যায় না। কয়েক বছর আগে রিমনের বাবা ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সে সময় রিমন শহরের গোয়ালগাড়ি এলাকার একটি বেসরকারি মাদ্রাসায় পড়তো। কিন্তু মাদ্রাসায় ভালো ফলাফল করতে না পারায় রিমনের মা তাকে মাদ্রাসা থেকে নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন।
সেখানেও খুব একটা ভালো ফলাফল না হওয়ায় রিমনকে বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেন রিমনের মা। এখন রিমন বাবার রেখে যাওয়া ছোট্ট একটি ব্যবসায় মা’কে সাহায্য করে। রিমনের মত তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া আদনেরও আর বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি। বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার জিয়ানগর গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তো আদন।
তার মা-বাবা দু’জনেই জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় যান। যাওয়ার সময় আদনকে তার নানির কাছে রেখে যান। এরপর থেকে আদনের আর বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি। নানির সাথে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাজ করে আদন।
বগুড়া সদরের শাখারিয়া ইউনিয়নের নাগরকান্দি গ্রামের সাথী পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার পরই বাল্যবিয়ের শিকার হয়। হাতে-পায়ে বড় হয়ে যাওয়ায় এবং ভালো সম্বন্ধ আসায় সাথীর বাবা-মা তাকে বিদ্যালয়ে পাঠানো বন্ধ করে দিয়ে দেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সের সাথী এখন এক সন্তানের মা।
বিনাপয়সায় সরকার প্রাথমিকে ছেলে-মেয়ে সবার পড়ালেখার সুযোগ করে দিয়েছে। পাশাপাশি বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিলেও প্রাথমিকে বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা অসচেতনতা, দরিদ্রতা, বাল্যবিয়ে এবং শিশুশ্রমকে দায়ী করছেন। ধুনটের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাধারণত সীমিত সামর্থ্যের পরিবারের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করে।
আরও পড়ুনআর্থিকভাবে অসচ্ছল হবার কারণে অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানকে অল্প বয়স থেকে বিভিন্ন পেশায় সম্পৃক্ত করে। যার দরুন যে বয়সে পড়াশোনা করার কথা, সে বয়সে শিশুরা পরিবারের উপার্জনের কাজে নিয়োজিত থাকে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ এভাবে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ছে। এছাড়া পিতা-মাতার অসচেতনতা রয়েছে।
বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক অভিভাবক এখনও শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অসচেতন। সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যাপারে তারা খুব বেশি জোর দেন না। ফলে সন্তানরা বিদ্যালয়ে গেল কিনা, সে বিষয়ে তারা খেয়াল রাখেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক জানান, শিক্ষকদের অসচেতনতার পাশাপাশি শিক্ষকদের পক্ষ থেকে যোগাযোগের অভাব ও সমন্বয়হীনতাও ঝরে পড়ার একটি কারণ। অনেক শিক্ষার্থী একটানা কয়েকদিন অনুপস্থিত থাকলেও শিক্ষকরা খোঁজ নেন না। বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে অভিভাবকদের সাথে শিক্ষকদের কোনো যোগাযোগ থাকে না।
একটানা কয়েক দিন একজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকলে সেই শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকে। গ্রামাঞ্চলে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের পরিবেশ প্রতিকূল ভেবে বিদ্যালয় ছেড়ে দেয়। দেখা যায়, কোনো কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন, কর্কশ ভাষা ব্যবহার করেন কিংবা কড়া শাসনের মধ্যে রাখেন।
এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। শিক্ষার্থীদের ভেতরে ভয় কাজ করলে তারা শেখার প্রতি আকৃষ্ট হয় না। এতে ভীত হয়ে দুর্বল শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় ত্যাগ করে।
বগুড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. রেজোয়ান হোসেন বলেন, বগুড়ায় গত পাঁচ বছরে প্রাথমিকে ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এজন্য মূলত অভিভাবকদের অসেচতনতা, বাল্যবিয়ে এবং শিশু শ্রম দায়ী। যেসব মা গার্মেন্টেসে কাজের উদ্দেশ্যে গ্রাম ছাড়েন, দেখা যায় তাদের দুটো সন্তানের মধ্যে ছোট সন্তানটিকে দেখার জন্য বড় সন্তানকে রেখে কাজে যান।
ফলে স্কুল পড়ুয়া ওই সন্তানের আর লেখাপড়া করা হয়ে ওঠে না। তাছাড়া অনেক দরিদ্র পরিবারের বাবা-মা মনে করেন, গরিব মানুষের সন্তান, শুধু নামটা লিখতে বা একটু পড়া জানলেই হবে। বিদ্যালয়ে না গিয়ে কাজে গেলে সংসারে উপার্জন বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, অভিভাবকদের সচেতন করতে ও ঝরে পড়া রোধ করতে আমরা মা সমাবেশ ডেকে মায়েদের সচেতন করাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। যে উপজেলাগুলোতে ঝরে পড়ার হার বেশি সেই উপজেলাগুলোতে ইতোমধ্যে আমরা এই কর্মসূচিগুলো শুরু করে দিয়েছি।
মন্তব্য করুন