ভয়াবহ বন্যা
এবছর ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে প্লাবিত হয়েছে লালমনিরহাট, কুঁড়িগ্রাম, ফটিকছড়ি, চৌদ্দ গ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা, কুমিল্লা নোয়াখালীসহ প্রায় এগারোটি জেলা। এদের মধ্যে বন্যা কবলিত তেমনি একটা জেলার নাম ফেনী। যেটি আমার বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। যেটা ফেনী নদীর তীরে অবস্থিত। মূলত ফেনী শহরটি ফেনী জেলার প্রাণ কেন্দ্র বলেই এই ফেনী নদীর নাম অনুসারে এই জেলাটির নাম হয়েছে ফেনী জেলা।
যে জেলাটির একসময় পূর্ব নাম ছিল শমশের নগর। ১৯৮৪ সালের ৬ ডিসেম্বরের আগপর্যন্ত এটি ছিল বৃহত্তর নোয়াখালীর একটি মহকুমা। এই ফেনী জেলারই উত্তরে রয়েছে কুমিল্লা জেলা। আর তার কিছুটা অনতিদূরে রয়েছে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। আর ফেনী জেলার দক্ষিণে রয়েছে চট্টগ্রাম জেলা ও বঙ্গোপসাগর। ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতি
বৃষ্টি আর পাহাড়ি উজানের ঢলের কারণে প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশের এসব অঞ্চলের মানুষের
আগে বন্যার দুর্ভোগ পোহাতে হত। কিন্তু পঞ্চ নদীর মূহুরী বাঁধ দেওয়ার কারণে এই অঞ্চলের
লোকজন যেমন বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেতো।তেমন বাঁধ দেওয়ার সুবিধার্থে শুষ্ক মৌসুমে সেচ সুবিধার জন্য এখানকার মানুষজন নিশ্চিন্তে চাষাবাদ করে ফসল ফলাতে পারতো। যে জন্য ফেনীর লোকজন এই বাঁধ নিয়ে আনন্দে
একসময় স্লোগান দিয়েছিল.....
পঞ্চ নদীর মুহুরী বাঁধ,
ফেনীর জন্য আশীর্বাদ।
কিন্তু, ফেনী জেলার মানুষদের পঞ্চ নদীর মুহুরী
বাঁধের এ সুখ ভোগান্তির অসুখ হয়ে একদিন কষ্ট দেবে তা- কি কেউ উপলব্ধি করতে পেরেছিল?
কে- জানতো....এই বাঁধটিই একসময় এ অঞ্চলের
মানুষজনদের জন্য দুর্ভোগ দুঃখ আর নিদারুণ হতাশার কারণ হবে?
একদিকে ভারত তিস্তা আর ফারাক্কার বাঁধ খুলে
বাংলাদেশের মানুষের চরম বিপদের মধ্যে ফেলে-
ছে। অন্যদিকে পঞ্চ নদীর মুহুরী বাঁধ ভেঙ্গে ফেনী
জেলায় মুহুর্মুহু করে জল প্রবেশ করে পুরো ফেনী জেলাটাকে প্লাবিত করেছে। পূর্বের বন্যার সকল রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়ে এ বছর ২০২৪ সালের বন্যা যে সবচেয়ে ক্ষয়ক্ষতি করেছে এই ফেনী জেলার অধিবাসীদের। এই ফেনী জেলারই একটি উপ- জেলার নাম ছাগলনাইয়া। আর ছাগলনাইয়া উপজেলার একটি গ্রামের নাম শিলুয়া। শিলুয়া গ্রামের বাসিন্দা রাহুল খুব সাদামাটা আর নিরীহ
প্রকৃতির মানুষ। তার স্ত্রী পারুল আর চার বছরের মেয়ে মিত,ু দুই বছরের ছেলে জিতু আর তার ষাট বছরের বৃদ্ধা মা সবিরন বেগমকে নিয়ে তার ছোট্ট একটি সংসার। আয় রোজকার বলতে তার ছোট্ট একটি চায়ের দোকানের আয় রোজগারের উপরে কোন রকম অসচ্ছলতা আর দরিদ্রতার মধ্যদিয়ে
অভাব-অনটনে তার সংসারটা চলে। বছর তিনেক হলো রাহুলের বাবা সামছুল হক মারা গেছে।
তার ঐ চায়ের দোকানটা তার বাবারই রেখে যাওয়া। তার বাবার রেখে যাওয়া শিলুয়া গ্রামে তিন শতক জমি আছে। সেই জমির উপর দুই রুমের টিনের ঘর তার। দোকানে লোকজনের আজ ভিড় থাকায়। অনেক রাতে রাহুল দোকান বন্ধ করে আজ বাড়ি ফিরেছে। মা- সবিরন বেগম
তখনো জেগে। ছেলের গলার শব্দ পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো বাড়ি এসেছিস বাবা রাহুল? রাহুল বললো
হ্যাঁ, মা এসেছি। স্বামী রাহুলের কন্ঠ শুনে পারুল
দরজা খুলে দিলো। রাহুল জিজ্ঞাসা করলো জিতু
মিতু কি ঘুমিয়ে পড়েছে ? পারুল বললো...
হুম কিছুক্ষণ আগে ঘুমালো। রাহুল বললো ও...
তারপর ছেলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো..
মা, ভাত খেয়েছে? পারুল বললো...হুম খেয়েছে।
আচ্ছা,খেতে দাও।। পারুল খাবার বেড়ে দিলো। খাবার খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো ।
হঠাৎ মধ্যরাতে আকস্মিক বন্যার জলের স্রোতে
বাড়িঘর তলিয়ে গেলো রাহুলদের। চারিদিকে অথৈজল। মানুষের চিৎকার কান্নাকাটির রোল পড়ে গেল। কয়েকফুট উঁচু জল প্রবাহিত হতে লাগলো। কি করবে রাহুল? সে তার মাকে পিঠে তুলে নিলো। পারুল মেয়ে মিতু আর কোলের শিশু ছেলে জিতুকে নিয়ে আশেপাশে উঁচু কোনো বিল্ডিং এ নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।
কিন্তু, প্রবল স্রোতে হঠাৎ মেয়ে মিতু তার হাত থেকে ফসকে গেলো। মা বলে....কেঁদে স্রোতের
মুখে ভাসমান মেয়ে মিতু চিৎকার করে উঠলো।
পারুল মিতু....মা আমার...বলে কেঁদে চিৎকার
করতে করতে স্বামী রাহুলকে বললো..ও মিতুর বাবা
মিতুকে বাঁচাও..। কি করবে রাহুল? তার পিঠে যে বৃদ্ধা মা। তাদের কান্নার ধ্বনিতে
আকাশ বাতাস সব ভারি হয়ে উঠলো। জিতুকে কোলে নিয়ে পারুল স্রোতে হাতড়িয়ে খুঁজতে লাগলো মেয়ে মিতুকে। ওদের দাদি বৃদ্ধা সবিরনও দিদিভাই ও দিদিভাই...তুই কই? বলে... কাঁদতে লাগলেন। একসময় সন্তান হারানো মা-বাবার চার চোখের নোনা জল হিংস্র সর্বনাশা
বন্যার জলে মিশে তা বেদনাবিধুর হয়ে যেনো করুণ আর্তনাদ করতে লাগলো। একসময় বন্যার
পানি নেমে গেলো। আশ্রয় কেন্দ্র থেকে সকলের মতো রাহুল পারুলও নিজেদের ঘরে ফিরে এলো।
ফিরলো না শুধু তাদের আদরের সন্তান মেয়ে মিতু।
পিতা-মাতা বেঁচে থাকতে সন্তান হারানো যে কতোটা কষ্টের। কতোটা বেদনাদায়ক তা কেবল সন্তান হারা সেই হতভাগা বাবা আর হতভাগিনী ভুক্তভোগী মায়েরাই জানে....।।
আরও পড়ুন
মন্তব্য করুন