দাঁতে কি আসলেই পোকা হয়?
দাঁতে আসলে কখনোই পোকা হয় না। দাঁতে হয় ডেন্টাল ক্যারিজ বা দন্তক্ষয় যেটাকে দাঁতে কালো দাগ হিসেবে চিনে থাকে সবাই। এক সময় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বা ব্যক্তিরা নানা কৌশলে দাঁতের মধ্য থেকে পোকা বের করে আনছেন এমনটা দেখাতেন। হাতুড়ে কিছু লোকজনই মূলত পোকা বের করে এনে দেখাতেন। তবে সত্যিটা হচ্ছে, দাঁতে কখনোই পোকা হয় না। এটা এক ধরনের মিথ।
কোন অবস্থাটাকে দাঁতে পোকা ধরা বলে থাকে মানুষ?
একটি ব্যাকটেরিয়া অর্থাৎ ক্যারিওজেনিক ব্যাকটেরিয়া আছে সেখান থেকে দাঁতে ক্যারিজ হয়, যেটাকে দাঁতের ক্ষয়রোগ বলে। সাধারণত ডেন্টাল ক্যারিজ থেকে দাঁতে গর্ত হয়। দাঁতের গর্তকে দাঁতে পোকা ধরা বলে থাকে মানুষ।
দাঁতের যত্নে প্রতিদিন ২ বার দাঁত ব্রাশ করার কথা। দিনে যদি কমপক্ষে একবারও সঠিক নিয়মে দাঁত ব্রাশ না করা হয় তাহলে লালাগ্রন্থি থেকে সবসময় লালা নিঃসৃত হতে থাকে। এর মধ্যে এক ধরনের উপাদান থাকে যেটা দাঁতের মধ্যে আঠালো স্তর তৈরি করে। মুখের ভেতর কিছু ভালো ব্যাকটেরিয়া আবার কিছু খারাপ ব্যাকটেরিয়া থাকে, যেখানে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়ার জীবাণু বসবাস করে।
এর মধ্যে ক্যারিওজেনিক ব্যাকটেরিয়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যদি ওরাল হাইজিন মেনে না চলা হয়, সঠিকভাবে দাঁত পরিষ্কার না করা হয়। এটিই দাঁতে গর্ত তৈরির প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে।
বাচ্চাদের এই সমস্যা বেশি হয়। ছোটবেলায় ওরাল হাইজিন মেনে না চলা এবং খাদ্যাভাসের কারণে শিশুদের দাঁতে গর্ত হয়। খাদ্যাভাসের মধ্যে চিনি জাতীয় বা মিষ্টি জাতীয় খাবার থাকে, যেটা ক্যারিওজেনিক ব্যাকটেরিয়াকে সাহায্য করে দাঁতে গর্ত তৈরির জন্য। এ ছাড়া চকলেট, চিপস, জাঙ্ক ফুড, এসিড কন্টেন্ট ফুড কোল্ড ড্রিংকস, আর্টিফিসিয়াল জুস শিশুদের দুধ দাঁতের মধ্যে অ্যাসিড তৈরি করে। অ্যাসিড প্রথমে দাঁতের শক্ত প্রতিরোধী আবরণ এনামেল ক্ষয় করে ডেন্টাল ক্যারিজ বা গর্ত সৃষ্টি করে। এরপর ডেন্টিন ক্ষয় করে এবং পরে দাঁতের যে মজ্জা থাকে অর্থাৎ পাল্প, সেটার মধ্যেও যায়।
এ ছাড়া যাদের ডায়াবেটিস আছে তারাও যদি সঠিকভাবে ওরাল হাইজিন মেনে না চলেন, তাদেরও দাঁতে ক্ষয় বেশি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যেহেতু তারা ইমিউনো কম্প্রোমাইজড, তাই এই ধরনের ব্যাকটেরিয়াগুলো বেশি আক্রমণ করে।
ডেন্টাল ক্যারিজের লক্ষণ: দাঁতে খাবার জমে থাকার কারণে সেখান থেকে ক্যারিজের উৎপত্তি হয়। অনেক সময় হয়তো কালো দাগ থাকে না, কিন্তু ক্ষয় হয়। দাঁতে কালো দাগ চোখে পড়ার আগে অনেকের দাঁতে প্রথমে সেনসিটিভিটি বা শিরশির অনুভূতি হয়। প্রতিবার ঠান্ডা বা গরম জাতীয় খাবার খাওয়ার সময় দাঁত শিরশির করে।
দৃশ্যমান ক্যাভিটি ছাড়া দুই দাঁতের মাঝখানে প্রক্সিমাল ক্যারিজ অনেক সময় দৃশ্যমান হয় না, কিন্তু সেনসিটিভিটির লক্ষণ থাকে। এরপর ক্যারিজ যদি আস্তে আস্তে বেড়ে মজ্জাতে চলে যায়, তখন ব্যথা হয়।
দাঁতে শিরশির ও কালো দাগ দেখার পর যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা করা উচিত। ডেন্টাল ক্যারিজ দাঁতের এনামেল ক্ষয় করেছে, ডেন্টিন কিছুটা আক্রান্ত, কিন্তু মজ্জাতে যায়নি- তাহলে দাঁতের শূন্য জায়গাটা ভর্তি বা ফিলিং করতে হবে।
আরও পড়ুনআর যদি সেটা না করা যায়, ডেন্টাল ক্যারিজ দাঁতের মজ্জাতে বা পাল্পে চলে গেলে রুট ক্যানেল চিকিৎসা করতে হয়। মজ্জা সরিয়ে ফেলার কারণে দাঁতটা মৃত হয়ে যায়, ন্যাচারাল দাঁতের মতো থাকে না। সেজন্য রুট ক্যানেল করা দাঁতে ক্যাপ, ক্রাউন বা মুকুট পরাতে হবে।
দাঁতের এনামেল ক্ষয় করে ক্যারিজ মজ্জাতে চলে গেলে তীব্র ব্যথা হয়। সেক্ষেত্রে ব্যথার ওষুধ খেয়ে নেন অনেকে, কিন্তু চিকিৎসা করানো থেকে বিরত থাকেন। এতে করে দাঁতের গোড়ায় বা শিকড় যেখানে আছে সেখানে গ্রানুলোমা ও ছোট ছোট সিস্ট হবে প্রথমে। ইনফেকশন হয়ে পুঁজ জমে যেতে পারে। আবার সেখান থেকে সেলুলাইটিস হতে পারে, এমনকি মরণব্যাধি হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
প্রতিরোধ : সঠিক নিয়মে প্রতিদিন ২ বার দাঁত ব্রাশ করতে হবে। ব্রাশ করার মাঝখানে খাবার খাওয়ার পর তা যাতে দীর্ঘসময় জমে না থাকে সেজন্য মাউথ ওয়াশ বা কুসুম গরম পানিতে মুখ কুলি করে নিতে হবে। দাঁতের ফাঁকের খাবার বের করার জন্য প্রয়োজনে সুতা বা ফ্লস ব্যবহার করতে হবে। দাঁতে সেনসিটিভিটি বা কালো দেখার পর ক্যারিজ বাড়তে না দিয়ে ফিলিং করিয়ে নিতে হবে। বছরে ২ বার দাঁতের প্লাক বা পাথর দূর করার জন্য স্কেলিং করা যেতে পারে। তাহলে দাঁতে অতিরিক্ত যে আবরণ ল্যাকটিক অ্যাসিড থেকে ক্যারিওজেনিক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটিয়ে ডেন্টাল ক্যারিজ তৈরি করে, সেটি প্রতিরোধ করা যাবে। খাদ্যাভাস পরিবর্তন করতে হবে। চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার, চকলেট, চিপস, কোমল পানীয় অর্থাৎ ডেন্টাল ক্যারিজ সৃষ্টি করে এমন খাবার পরিহার করতে হবে। প্রথম দিকে অভিভাবকদের দায়িত্ব হবে শিশুদের দুই বেলা ব্রাশ করানো। স্কুল শিক্ষকরা যদি ওরাল হাইজিন ও টুথব্রাশ বিষয়ে শেখান তাহলে সেটি অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে শিশুদের কাছে। ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করতে হবে। খাবার জমে পাশের দাঁতকে নষ্ট করে এমন ভাঙা দাঁত, দাঁতের গোড়া, আক্কেল দাঁত প্রয়োজনে সরাতে হবে।
শরীরের প্রতিটি অঙ্গের মত দাঁতের যত্ন নিতে হবে। এটা বুঝতে পারলেই ডেন্টাল ক্যারিজসহ দাঁতের যেকোনো সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়।
ডাঃ মোঃ সাবিবর মোস্তাক রহমান (ডুরেন)
বি. ডি. এস (ডি ইউ)
ওরাল এ্যন্ড ডেন্টাল সার্জন
সারা ডেন্টাল কেয়ার
সাতানিবাড়ি, শেরপুর রোড,
বগুড়া।
মন্তব্য করুন