এডিস মশার আগ্রাসন
মশা যদি মানুষের জীবন নিয়ে টানাটানি করে তাহলে সেটি কতটা ভয়ানক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গুও অনেকটা তেমনই। এডিস মশার এক শূলে প্রবাহিত এই রোগ এতই ভয়াবহ নারী-পুরুষ, শিশু বৃদ্ধ সবাই এর সমান ফল ভোগ করে। করেও নিস্তার নেই। ডেঙ্গুতে মারাত্মক শারীরিক ক্ষতিসহ যে কারও মৃত্যু হতে পারে।
চলতি অক্টোবর মাসের ২৩ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আগের মাস সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। চলতি বছরগুলোতে ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে জানানো হয়, একদিনে ডেঙ্গুতে আরো ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে ১ হাজার ১৩৮ জন নতুন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জুলাই থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। জুলাইয়ে ২ হাজার ৬৬৯ জন আক্রান্ত হন। আগষ্টে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ হাজার ৫২১ জনে। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত প্রায় ৩ গুণ বেড়ে হয় ১৮ হাজার ৯৭ জন। চলতি মাসে এরই মধ্যে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ২৫৮ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৫৩ হাজার ১৯৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গেল বছর দেশে তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। অপরদিকে এক হাজার ৭০৫ জন মশাবাহিত এই রোগে মারা গেছেন।
যা দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক স্বাস্থ্য কর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে
সারা দেশে ডেঙ্গু ধরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ ছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই বছর মশাবাহিত রোগটিকে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা যায়।
বয়স্ক ব্যক্তি, শিশু, স্থূলকায় ব্যক্তি, অন্ত:সত্ত্বা নারী ডেঙ্গুর সংক্রমণের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া যাদের ডায়াবেটিস, উক্ত রক্তচাপ, হৃদযন্ত্র, কিডনি, ফুসফুস ও যকৃতের সমস্যা আছে তারাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে। তাই এ ধরনের ব্যক্তিরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাওয়া দরকার যাতে তাদের অবস্থা গুরুতর না হয়।
আরও পড়ুনআমরা মনে করি, সরকারের উচিত শহর ও আঞ্চলিক উভয় পর্যায়ে ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া দরকার। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে ডেঙ্গুর মৃত্যুহার কমাতে বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থা ও পদ্ধতির পরিবর্তন করা জরুরি। ঢাকার বাইরে মৃত্যুহার বেশি কারণ হিসাবে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাব ও ডেঙ্গু শনাক্ত করতে না পারা। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এ ব্যাপারে উদাসীনতার কোনো অবকাশ নেই।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে পৃথিবীর প্রায় ১৩০টি দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটেছিল। এর মধ্যে ৭টি দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ তীব্র হয়েছে- যার মধ্যে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ছাড়াও ডেঙ্গুর প্রকোপ তীব্র হওয়া দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে ব্রাজিল, বুরকিনা ফাসো, ফিজি, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম।
এডিস মশার কারণে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় মানুষ। এ থেকে রেহাই পেতে হলে সতর্কতা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই। এডিস মশা ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে অযৌক্তিক ভীতিতে আতঙ্কিত না হয়ে জ্বর যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে সে চেষ্টা করতে হবে।
পরিমিত পানি পানে উদ্যোগী হতে হবে। গুরুতর অসুস্থ বোধ হলে হাসপাতালে ভর্তি বা চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতে হবে। এডিস মশা বন-জঙ্গলে নয় মানুষের বাসগৃহেই আস্তানা গাড়ে। এ ব্যাপারে সবাই সতর্ক হলে এ মশার আগ্রাসন একেবারে থামিয়ে দেওয়াও সম্ভব। ডেঙ্গু জ্বর থেকে রেহাই পেতে হলে এডিস মশার বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করতে হবে।
এই মশা নির্মূলে জনসম্পৃক্ততা ও জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। সমন্বিত উদ্যোগ সফলভাবে কাজে লাগালে ডেঙ্গুর আগ্রাসন সফলভাবে রুখে দেওয়া সম্ভব। আমরা মনে করি, ডেঙ্গু সংক্রান্ত পরিস্থিতি আমলে নিতে হবে। ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ডেঙ্গু থাবা বিস্তার করলে তা বিপর্যয় অনিবার্য করে তুলবে, যা থেকে সতর্ক থাকার বিকল্প নেই।
মন্তব্য করুন