আমরা বড়জোর বিদ্বান, শিক্ষিত নই!
বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাই চড়ি শখের বোটে/ মাঝিরে কন বল তো দেখি, সূর্য কেন ওঠে?/ চাঁদটা কেন বাড়ে-কমে/ জোয়ার কেন আসে/ বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফেলিয়ে হাসে- আজ আমাদের দেশটা বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাইয়ের ভিড় লেগেছে। এসব বিদ্যে যোগাড় হয়েছে সার্টিফিকেটের দৌলতে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, বিদ্যা সহজ শিক্ষা কঠিন, বিদ্যা আবরণে, শিক্ষা আচরণে।
কবিগুরুর এই সহজ অথচ গভীর কথা মর্ম উপলব্ধি করা আজকের সমাজের কাছে প্রায় অসাধ্য। কারণ এরা গুলিয়ে ফেলতে অভ্যস্ত। আবার এত গভীরে গিয়ে কোনো অর্থ বের করার মতো সময়টাও নেই। আবার কবিগুরুকে নিয়েও সভ্য সমাজের বিদ্যে বোঝাই বহু বাবুমশাইয়ের সন্দেহ রয়েছে।
বিদ্যা অর্জন করা বেশ সহজ। বলা যায় একেবারেই সহজ কাজ। বিদ্যে মানুষকে খুব বেশি মানুষ হিসেবে পরিচিত করতে পারে না। যা মানুষকে মানুষের স্বীকৃতি দিতে পারে সেটি হলো শিক্ষা। শিক্ষা হলো একটি পদ্ধতি যা আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক হতে পারে তবে মানুষের আচরণকে একটি স্থায়ী পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায়। এবার উদাহরণ দিয়ে বিদ্যা ও শিক্ষার পার্থক্য বুঝিয়ে দেই।
খুব ছোটবেলা থেকেই আমাদের বইয়ে এবং পরিবার ও সমাজ আমাদের মিথ্যা না বলার শিক্ষা দেয়। আসলে কিন্তু এটা শিক্ষা না বিদ্যা। এই বিদ্যা পুুঁথিগত বা অপুঁথিগত হতে পারে। এটি যদি কোনো পরিবার বা সমাজে চর্চা করা হয় তাহলে এটি পরিণত হয় শিক্ষায়।
রবীন্দ্রনাথের কথায় আবরণ এবং আচরণ এই দুইয়ের পার্থক্য এখানেই। সত্য বলার অভ্যাস পরিবারে হচ্ছে না। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সাথে মিথ্যা বলছে, সন্তান মা-বাবার সাথে মিথ্যা বলছে, সমাজে একে অপরের সাথে মিথ্যা বলছে।
নেতারা মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছেন। এই দেখে দেখে একটি শিশু বড় হচ্ছে। সে বইয়ে শিখল এক আর সমাজে চর্চা হচ্ছে আরেক। অর্থাৎ সমাজ চলছে উল্টোপথে। এখন শিশুটি দেখছে সমাজে মিথ্যা বলার লাভ বেশি। সে সেটাই করছে। যদি এর উল্টোটা অর্থাৎ বইয়ে যাই থাক চর্চা হতো সত্য বলার তাহলে কিন্তু শিশু সত্য বলাই শিখতো।
আবরণ মানে আমাদের পোশাক-আশাক এবং আচরণ হলো ব্যবহার যা আমরা অন্যের সামনে দেখাই। অবস্থা এমন হয়েছে যে আমি-আপনি যে শিক্ষিত সেটা প্রমাণ করতে সার্টিফিকেট ঝুলিয়ে রাখতে হবে! কারণ মানুষ যত বিদ্বান হচ্ছে, সমাজ তত অসভ্য হচ্ছে। আমরা বিদ্বান হচ্ছি বড়জোর, শিক্ষিত নয়! যারা এই পার্থক্য বুঝতে অক্ষম তিনি ওই বিদ্বান।
ফেসবুকে ঢুকলেই দেখা যায় নীতিবাক্যের ছড়াছড়ি। যদি এটা সত্য বলে ধরে নেন মানে সেই ব্যক্তিদের কথা এবং তাদের জীবন যাপন পদ্ধতি সত্য বলে বিচার করেন তাহলেই আপনি ঠকেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব নীতিবাক্য আওড়ানো মানুষের সাথে তাদের ব্যক্তিক আচরণ এবং দর্শনের বিস্তর ফারাক রয়েছে। ঘরে ঘরে খুঁজলে সার্টিফিকেটধারী মানুষের কোনো অভাব নেই।
বড় বড় ডিগ্রী, বড় বড় কথা অথচ কাজকর্ম নিতান্তই অবিবেচকের মতো। তারা যে শিক্ষিত হতে পারেননি, আমরা যে মানুষ পাচ্ছি না সেটি কিন্তু শিক্ষার দোষ না, সেটি হলো চর্চার দোষ। এই তো গণমাধ্যমে দেখলাম কারিগরী বোর্ডের সার্টিফিকেটের কেলেঙ্কারী। কতজন পকেটের টাকা খরচ করে সার্টিফিকেট কিনে সমাজে দামী চাকরি করছেন, এখন যদি তাদের আপনি শিক্ষিত ভাবে তাহলেই সর্বনাশ! তারা অবশ্য বিদ্বানও না।
আরও পড়ুনচুরি করে আর যাই হোক বিদ্বান হওয়া যায় না। কথায় বলে, গুরু মারা বিদ্যা! এই বিদ্যা অর্জন করে শিষ্য গুরুকে মারার ক্ষমতা অর্জন করে। যদিও এই বিদ্যা ভুল এবং অন্যায্য তবুও আছে। শিক্ষককে তো আজ অনেকেই মারছে। গায়ে হাত তুলছে, জোর করে পদত্যাগ করাচ্ছে, লাঞ্ছিত করছে খোলা রাস্তায়। এই বিদ্যা অর্জন তো সেই সব শিক্ষকের বা গুরুর কাছ থেকেই শেখা।
এমন বিদ্যাই শিখেছে যে গুরুকে মারতে দ্বিধাবোধ করছে না। এখন এদেরও যদি শিক্ষিতদের কাতারে ফেলেন তাহলে তো একদিন সমগ্র সমাজটাই অচল হয়ে যাবে। অথচ দেশ ভরে যাচ্ছে বিদ্বান মানুষে। সার্টিফিকেটধারীদের পদভারে রাজপথ ভারী হচ্ছে। মানুষ তো পাচ্ছি না।
মানুষ হলে দেশটা অনেক আগেই আরো সুন্দর হয়ে উঠতে পারতো। দেশকে নিয়ে আজ স্বপ্ন দেখা মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। অথচ নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা মানুষের সংখ্যা ভুরি ভুরি। নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবা এবং অন্যকে বোকাসোকা ভাবা খুব সহজ কাজ।
আমাদের বিদ্বান দরকার না, শিক্ষিত মানুষ দরকার। চর্চায় শিক্ষিত দরকার, স্যুট, টাই পরা ভদ্রলোকের দরকার নাই। তা না হলে সেই বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাইয়ের চাপে দেশের মাটি ধসে পড়তে পারে!
অলোক আচার্য
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
01737-044946
মন্তব্য করুন