ভিডিও বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

অস্থিতিশীল পরিস্থিতির বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে

অস্থিতিশীল পরিস্থিতির বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে, ছবি : দৈনিক করতোয়া

বাংলাদেশে অভূতপূর্ব এক গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নজির বিহীন ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছে অকুতোভয় ছাত্র-জনতা। বাংলাদেশ এক দশকের বেশি সময়ের গণতন্ত্রহীনতা, অপশাসন ও বাকস্বাধীনতাহীনতা থেকে হয়েছে মুক্ত। গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন সবাই নির্ভয়ে লিখতে পারছে, কয়েক দিন আগেও যা ছিল প্রায় অকল্পনীয়।

তবে এ জন্য মূল্য দিতে হয়েছে অনেক। যা প্রতিটি বিবেকবান মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছেন। যার ফলশ্রুতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। গণ-অভ্যুত্থানের সূচনায় একটি ধাপ ছিল দীর্ঘকালীন শাসনব্যবস্থায় থাকা কর্তৃত্ববাদী ও কার্যত অগণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন। সে পর্বটি সম্পন্ন হয়েছে।

এ অসম্ভবকে সম্ভব যারা করলেন, সেই তরুণ সম্প্রদায় ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন। এর জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন পাঁচ শতাধিক ছাত্র-জনতা। গুরুতর আহত অবস্থায় আছেন কয়েক হাজার। দ্বিতীয় ধাপ একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন। এটার নামই বলে দিচ্ছে সরকার দীর্ঘমেয়াদি হবে না। এর সামনে রয়েছে লাখো তরুণসহ গোটা গণতন্ত্রকামী জনগণের নতুন বাংলাদেশ করার প্রাথমিক দায়িত্ব।

সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থিতিশীল হলে জাতির দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা একটি আন্তর্জাতিক মানদন্ডে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। এ কাজটি কেউ কেউ চাইলেও অতি দ্রুত করার সুযোগ নেই। কিন্তু বর্তমানে ক্যাম্পাস থেকে পাহাড় পর্যন্ত অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা সর্বত্র। এটা অবশ্য চলছে দেড় মাস ধরেই।

একের পর এক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে ড.মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে। সর্বশেষ সংযোজন পাহাড়। সেখানকার অশান্তির পেছনে বাইরের সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত করেছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।

এর আগে পোশাকখাতে অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে হামলায় বহিরাগতদের যোগ দেয়ার বিষয়টি ছিল স্পষ্ট। তবে একদল পোশাক কারখানা মালিকের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কিছু কারখানায় বেতন বকেয়া রাখা হয়েছিল, হচ্ছে। এর আগে সচিবালয়ে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করেছিল আনসার সদস্যরা। পরে সেখানে ছাত্রদের যেতে হয়।

পুলিশ এখনো পুরোদমে কাজ করছে না। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, পুলিশের পুরোদমে কাজ শুরু করতে আরও সময় লাগবে। নানা দিক বিবেচনায় সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। প্রশাসনেও এক ধরনের স্থবিরতা রয়েছে। এখন সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলের বিষয়টি। এরইমধ্যে সেখানে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। যদিও পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে। পাহাড় বরাবরই স্পর্শকাতর স্থান। এ অঞ্চলে নিরাপত্তা সংকটও দীর্ঘ দিনের।

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফের বক্তব্যের পর সে আলোচনা আরও তীব্র হচ্ছে। রাঙ্গামাটিতে রাজনৈতিক দল ও আঞ্চলিক দলের নেতাসহ নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে আগের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, পাহাড়ি-বাঙালিদের ঘটনাগুলোতে দেশের বাইরের শক্তি ও পতিত স্বৈরাচারের ইন্ধন রয়েছে। আমরা সম্প্রীতি চাই।

কিন্তু জানি না কোথায় ছন্দপতন হচ্ছে। ছন্দপতনের বিষয়ে সবাই একটি বাক্য উচ্চারণ করেছে; সেটি হলো ষড়যন্ত্র। বাইরে থেকে একটি ষড়যন্ত্র হচ্ছে, আমাদের এই সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য। এর পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি নির্মম হত্যাকান্ড নিয়েও ব্যাপক আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে সরকার এবং প্রশাসন কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ঘটনায় একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতার নাম এসেছে। শেখ হাসিনার পতনের দেড় মাস পরও ক্যাম্পাসগুলো এখনো পুরোমাত্রায় সচল হয়নি। এই পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসগুলো কী প্রক্রিয়ায় চলবে-তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় প্রাথমিকভাবে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখনো অবশ্য প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে সর্বত্রই একধরনের অস্থিরতা রয়েছে। যেকোনো বড় গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের পর এটা নজিরবিহীন নয়। আর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দেড় দশকের বেশি সময় টানা ক্ষমতায় ছিল। দলটির এক শ্রেণির নেতারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। অভিনব পরিস্থিতিতে আত্মগোপনে চলে গেলেও তাদের অর্থ তাদের কাছেই রয়েছে। সে অর্থ দিয়ে তারা নানা রকম অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছেন।

শাসনামলের পুরোটা সময়ই আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশকে ব্যবহার করে বিরোধীদের আন্দোলন দমন করে। জুলাই আন্দোলনেও পুলিশ চরম শক্তির ব্যবহার করে। এক হাজারের বেশি আন্দোলনকারী এসময় নিহত হন বলে বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে। নিহতদের তালিকা অবশ্য এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় পুলিশের ওপর মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়।

আরও পড়ুন

৫ই আগস্ট থানায় থানায় হামলা হয়। এরপর একযোগে সব পুলিশ সদস্য থানা ছেড়ে চলে যান। পৃথিবীর ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। গেল দেড় মাসে পুলিশে নানা রদবদল হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত পুলিশকে পুরোদমে কার্যকর করা যায়নি। এ সুযোগও কেউ কেউ নেয়ার চেষ্টা করছেন। প্রশাসনসহ সর্বত্র কয়েকটি স্তরে বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা রয়েছেন। যে কারণে রদবদল করেও খুব বেশি লাভ হচ্ছে না। একজন উপদেষ্টা প্রশ্ন তুলেছেন, শুধু সংস্কার করলেই কি হবে? সংস্কার কার্যকর করবেন কারা? 

বাংলাদেশ ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও সক্রিয় রয়েছে। দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দুনিয়া সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে। তবে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বিবেচনায় রাখতে হবে, গত ১৬ বছর নির্দয় দলীয়করণ হয়েছে। এমনকি নতুন নিয়োগ পর্বেও পিএসসি কর্তৃক সুপারিশকৃত প্রার্থীর পুলিশি ও গোয়েন্দা তদন্তেও শুধু তার নয়, অকারণে তার বৃহত্তর পরিবারে রাজনৈতিক পরিচিতি প্রাধান্য পেয়েছে।

অথচ নিয়মানুযায়ী সুপারিশকৃত প্রার্থীদের রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কাজ বা ফৌজদারি অপরাধই এসেছে বিবেচনায়। এভাবেই আমাদের হতভাগ্য দেশটিতে বেশ কিছু মেধাবী ছেলেমেয়ে কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও বঞ্চিত হয়েছেন নিয়োগ থেকে। পদোন্নতিও হয়েছে একই প্রক্রিয়ায়। এখন থেকে হয়তো এমনটা হবে না। হয়তোবা এ দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। কিন্তু নতুন দলীয় সরকার এসে কী করে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির পর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সরকার পরিবর্তনের সুযোগ কার্যত না থাকায় এটা ষোলোকলা লাভ করে। এতে রাজনীতিকদের ইন্ধন জোগান বেশ কিছু স্বার্থান্বেষী তুলনামূলক নিম্নমানের কর্মকর্তা। তাদের ষোলোকলা পূর্ণ হলেও দেশের শাসনব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে গভীর ক্ষত। ব্যবস্থাটি প্রসারিত হয়েছে উচ্চ আদালতসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বাস্থ্যব্যবস্থায়। হতে পারে বিদায়ী সরকারের সময়কালে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে।

বেড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রেও সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা একটি শ্রেণী দুর্নীতি করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। অন্যদিকে বেড়ে গেছে আয়বৈষম্য। অবিভক্ত পাকিস্তানে আইয়ুব খান অনেক উন্নয়ন কাজ করেছিল। কিন্তু দমিয়ে রেখেছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। ফলে এক পর্যায়ে জনগণ এমনই একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

প্রকৃতপক্ষে জনগণের অনেক প্রত্যাশার মুখে দায়িত্ব নিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাদের অগ্রাধিকারে রয়েছে সেই প্রত্যাশা পূরণ। মোটকথা হচ্ছে, ভয় ও গুমোট অবস্থা থেকে মুক্তি চায় মানুষ। আর একটা সহিংসতার ঘটনা, একটা মৃত্যুও কাম্য নয়। সফল এই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া ছাত্র-জনতা মনেপ্রাণে এসব সহিংস কর্মকান্ডের অবসান চান। বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর-মন্দির পাহারা দেয়ার দায়িত্ব নিতে দেখা গেছে তাদের।

অনেক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকেও এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। এ তরুণ প্রজন্মের আদর্শের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কারা যেকোনো সহিংসতা ঘটাচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হোক। এরই মধ্যে গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের চাওয়া অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

দেশের বেশিরভাগ মানুষ এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। এ গণ-অভ্যুত্থান তাদের নতুন বাংলাদেশ গড়ার আশা জুগিয়েছে। এবারও যেন তাদের আশাভঙ্গ না হয়। এটাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা।


লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

raihan567@yahoo.com

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিইসি হলেন এ এম এম নাসির উদ্দীন

সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখব : প্রধান উপদেষ্টা

মহাখালী থেকে রিকশাচালকদের সেনাবাহিনীর ধাওয়া 

জামিন পেয়েছেন সাংবাদিক শফিক রেহমান

ডক্টর হলেন ক্রিকেটার মঈন আলী

মেসিদের কোচের তালিকায় জিদান-জাভি-মাসচেরানোর নাম