হারতে হারতে জিতে যাওয়া এক জীবন কাহিনী!
কর্নেল স্যান্ডার্স! কেএফসির মালিক। তার রেসিপি এখন বিশ্ব জুড়ে জনপ্রিয় । এই রেসিপিকে জনপ্রিয় করতে ওই বৃদ্ধকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল জীবনের বাষট্টিটি বছর। তার পুরো নাম হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডার্স। আমেরিকার ইন্ডিয়ানায় জন্ম ১৮৯০-এর ৯ সেপ্টেম্বর। বাবা উইলবার ছিলেন কৃষক। মা, মার্গারেট ছিলেন ঘরসংসার নিয়ে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন হারল্যান্ড।
হারল্যান্ডের বয়স যখন পাঁচ, হঠাৎই মারা যান তাঁর বাবা। সংসার চালানোর জন্য মা মার্গারেটকে বের হতে হলো উপার্জনের জন্য। এ সময় ছোট দুই ভাইবোনকে দেখভালের দায়িত্ব পড়ল হারল্যান্ডের উপর। তাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে নিজেই মাথা খাটিয়ে বের করলেন মাংস আর পাউরুটি দিয়ে চটজলদি রকমারি পদ।
এই শেফগীরী হারল্যান্ডকে বেশ আনন্দ দিত। কিন্তু বেশি দিন এই জীবনে থাকতে পারলেন না হারল্যান্ড। পারিবারিক অর্থকষ্টে পড়ে দশ বছর বয়সে বাধ্য হলো খামারবাড়ির কাজ নিতে। এর দু’বছর পরে মা মার্গারেট আবার বিয়ে করলেন। কিন্তু তার এই স্বামী কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না মার্গারেটের প্রথম পক্ষের তিন সন্তানকে।
সৎ বাবার অত্যাচারে বিরক্ত হয়ে তেরো বছর বয়সে বাড়ি ছাড়লেন হারল্যান্ড। চলে গেলেন ইন্ডিয়ানার অন্যপ্রান্তে। মায়ের অনুরোধে আশ্রয় জুটল এক আত্মীয়ের বাড়িতে। এখানে জীবিকা নির্বাচনের জন্য হারল্যান্ডকে বিভিন্ন সময় বাসের কন্ডাক্টর, সেনাবাহিনীতে চাকরি, রেল ইঞ্জিনে বেলচা দিয়ে কয়লা ফেলা, কয়লার ইঞ্জিনের ছাই সাফাইয়ের কাজ করতে হয়েছে।
সংগ্রামী জীবনের ১৯ বছর বয়সে হরল্যান্ড বিয়ে করলেন জোসেফিনকে। এক এক করে এক ছেলে, দুই মেয়ের বাবা হলেন। যদিও পুত্রসন্তান শৈশবেই মারা যায়।
রেলের চাকরির পাশাপাশি করেসপন্ডেন্স কোর্সে আইন পড়তে শুরু করলেন হারল্যান্ড। কিন্তু বিবাদে জড়িয়ে পড়ায় রেলের চাকরি হারাতে হলো তাকে। এর প্রভাবও পড়ল সংসারে। দুই মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী জোসেফিন চলে গেলেন তাঁর বাবা-মায়ের কাছে।
আইন পাস করে শুরু করলেন প্র্যাক্টিস। ভালই জমিয়েছিলেন। কিন্তু বদমেজাজের জন্য ভাটা পড়েছিল মক্কেল-সংখ্যায়। জড়িয়ে পড়েন মক্কেলের সঙ্গে ঝামেলায়। যার ফলে বন্ধ হয়ে গেল আইন প্র্যাক্টিস।
এরপর কাজ নিলেন জীবনবীমায়। ক’দিন কাজের পরে শুরু করলেন নিজের ফেরি সংস্থা। সেটাও বন্ধ করে আরম্ভ করলেন অ্যাসিটিলিন বাল্ব তৈরির কাজ। এ সময় বাজারে এসে গেল নতুন ইলেকট্রিক বাল্ব। যার কারণে বন্ধ হয়ে গেল তার বাল্বের কাজ।
কাজের সূত্রেই হারল্যান্ড এলেন কেন্টাকিতে। সেখানেও কিছু দিন এ কাজ, সে কাজের পরে তেল সংস্থায় নিলেন চাকরি। কাজের ফাঁকে শুরু করলেন শৈশবের শখ, রান্না করা। নতুন করে শুরু করলেন ফ্রাইড চিকেনের রেসিপি। আর খাওয়াতে লাগলেন পরিচিতদের।
আরও পড়ুনকেন্টাকির যে গ্যাস স্টেশনে কাজ করতেন তার পাশেই সাজিয়ে রাখতে শুরু করলেন নিজের তৈরি ফ্রায়েড চিকেন। এই খাবারের স্বাদ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা। তখন হারল্যান্ড এই ব্যবসাকে গুরুত্ব দিলেন। ধীরে ধীরে ফ্রায়েড চিকেন বিক্রিই হয়ে উঠল তাঁর মূল ব্যবসা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য বন্ধ হয়ে গেল তাঁর এই ব্যবসা। কয়েক বছরের বিরতি। তারপর ১৯৫২ সালে আমেরিকার উটা-তে সাউথ সল্টলেক এলাকায় নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করল হারল্যান্ডের রেসিপিতে ফ্রাইড চিকেনের দোকান।
এর নাম দিলেন ‘কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন’। যেহেতু কেন্টাকি থেকে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার স্মরণে এই নাম রাখা। এর সংক্ষিপ্ত ‘কেএফসি’ নামে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
তাঁর এই বাউন্ডুলেপনা মেনে নিতে পারেননি স্ত্রী জোসেফিন। ১৯৪৭ সালে জোসেফিনের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে যায় হারল্যান্ডের। অবশ্য বিয়ে ভাঙার আগেই প্রেমে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। নিজের দোকানের কর্মী ক্লদিয়াই ছিল তাঁর প্রেমিকা।
মূলত ক্লদিয়ার উৎসাহ আর অনুপ্রেরণায় নতুনভাবে পথ চলতে শুরু করে কেএফসি। এই ক্লদিয়াকে ১৯৪৯ সালে বিয়ে করেন হারল্যান্ড। তবে কেএফসি নিয়েও বেশি দিন থাকতে পারেননি হারল্যান্ড। বেশি দিন কোনও কিছুই ভাল লাগত না তাঁর। একঘেয়ে লাগতে শুরু হওয়ায় ১৯৬৪ সালে বিক্রি করে দেন কেএফসি।
মাত্র ২ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে হাতছাড়া করেন কেএফসি। বিক্রির সময় দুই পক্ষই একটি চুক্তি করেছিলেন। তাহলো লোগোতে হারল্যান্ডের ছবি থাকবে, আর এর বিনিময়ে মোটা পারিশ্রমিকও পাবেন হারল্যান্ড।
কোম্পানির হাতবদলের পরে মনে হয়েছিল তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আরও বেশি অর্থ পাওয়া উচিত ছিল। তাই তিনি মামলায় গেলেন। কিন্তু অনেক দেরি হওয়ায় নতুন মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করেও সুবিধে করতে আদায় করতে পারেননি তিনি।
জীবন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মেতে থাকা কর্নেল অব কেন্টাকি বা হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডার্সের জীবনাবসান ঘটে ১৯৮০ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু তাঁর রেসিপি এখনও স্বাদ দিয়ে যাচ্ছে সমগ্র বিশ্ববাসীকে।
মন্তব্য করুন