পঙ্গুত্ব মৃত্যুর চেয়ে বিভীষিকাময়
গণহত্যা ও গণঅভ্যুত্থানের রাতগুলোতে ঘুমাতে পারিনি। দেশের ওই বাস্তবতায় কোনো সুস্থ মানুষেরই ঘুম আসার কথা নয়। তারপর গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে। দেশ আজ ‘মুক্ত’। রাষ্ট্রীয় গণহত্যা ও গোলাগুলি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু আজও রাতের পর রাত ঘুম আসে না। হাসপাতালে-ক্লিনিকে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গোনা; কল্পনায় নিয়তির বীভৎস মুখ নিরীক্ষণ করতে থাকা আহত-পঙ্গু ছাত্র-জনতার ছিন্ন ভিন্ন ছবি ভেসে আসে বারবার।
গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে গণমানুষেরা। এমন বিপরীতমুখী নাগরিকেরা সেখানে জোট বাঁধে, বাস্তবে যাদের কোনোদিন পাশাপাশি হাঁটা তেমন একটা হয় না। সেখানে অপরিচিত নারী-পুরুষ একসাথে হাত ধরাধরি করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস রুখে দাঁড়াতে মরিয়া হয়। সেখানে শিক্ষিত-মূর্খ হাত ধরাধরি করে মিছিল করে। সেখানে আস্তিক-নাস্তিক কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
এভাবেই গণঅভ্যুত্থান সফল হয়, অশুভ শক্তির পতন হয়। কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর চোখ ঝলসানো বিজয়ের আলোয় দিগন্তপ্লাবী বিজয় মিছিল চলে সম্মুখপানে। ক্রমে পিছনে পড়ে যেতে থাকে অগণন শহীদেরা। মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময় অন্ধকারে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, মৃত্যুর সুযোগ হয়নি এমন আহত বিপ্লবীরা। বিজয়ের ‘আলো’ কিংবা ‘আনন্দ’ কতখানি ছুঁতে পারে তাঁদের!
৫ আগস্ট থেকে দীর্ঘ বিজয় মিছিলে আমরা যারা চলেছি উত্তেজনার উত্তঙ্গে সওয়ার হয়ে; হয়তো আমাদের অধিকাংশেরই যায়নি কিছুই, হারায়নি কিছুই। কিন্তু যাদের গিয়েছে জীবন, নাম জানা, নাম না-জানা; শুয়ে আছে যারা অজ্ঞাতনামা হয়ে জ্ঞাত-অজ্ঞাত গণকবরে। যে কিশোর একটি হাত হারিয়েছে, যে তরুণ একটি পা হারিয়েছে, যে বালক হারিয়েছে একটি চোখ।
যাদের শরীর থেকে অঝোর ধারায় ঝরে গেছে রক্ত। যে শিশু, যে যুবক শরীরে বহন করছে আমৃত্যু অমোচনীয় জখম, অপূরণীয় ক্ষত এবং ক্ষতি। যারা আজও পড়ে আছে অনিশ্চয়তায়, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাঁদের কথা কি আমরা ভুলতে বসেছি?
আমরা ভেবেছি কি? যার দুই হাত নেই, সে কী করে আজ বহন করে নিয়ে যাবে বিজয়ের পতাকা? যে দুই পা হারিয়েছে, সে কি শামিল হতে পারবে বিজয়ের মিছিলে? দুচোখ হারিয়ে যারা আজ অন্ধ, তাঁদের কি দেখা হবে বিজয়ের সূর্য? তাঁদের কি কোনোভাবে বোঝানো যাবে, বিজয়ের আলো দেখতে কেমন হয়? তাঁদের চোখের মধ্য দিয়ে মগজের গহীন কোষে কোনোদিন তো পৌঁছাবে না এক কণা বিজয়ের বর্ণিল আলো।
যে মা-বাবা সন্তান হারালো তাঁরা কি কোনোদিন অনুভব করতে পারবে, কেমন হয় বিজয়ের আনন্দ? যে স্ত্রী স্বামীকে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে আজ অকুল পাথারে, তাঁর কাছে বিজয়ের সংজ্ঞা কেমন, তা ভাবার দুঃসাহস কারোর আছে কি? ভাইয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল ফুরিয়ে ফেলেছে যে বোন; অথবা বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে, বাবা ঘুম থেকে উঠবে বলে অপেক্ষায় আছে যে দুধের শিশু, আমার সাহস নেই তাঁর সামনে ‘স্বাধীনতা’ বা ‘মুক্তি’ শব্দটি উচ্চারণ করি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বেশকিছু ভিডিওতে যাদের দেখা যাচ্ছে এবং যারা পড়ে আছে অলক্ষ্যে, তাঁদের মর্মান্তিক দুরবস্থা আজ নতুন বাংলাদেশের মানুষকে ছুঁতে পারছে কি না জানি না। মাথার ভিতর, বুকের ভিতর একাধিক গুলি বরণ করে আজ কথা বলার ক্ষমতা হারানো আহত বিধ্বস্ত মানুষকে আশাহীন নির্বাক তাকিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
ছিন্নভিন্ন মগজে তাঁদের যদি ভাবনার ক্ষমতা এখনো অবশিষ্ট থেকে থাকে তাঁরা হয়তো ভাবছে, তাঁদের কেন মৃত্যু হলো না। এরকম অবস্থায় তো তাঁরা বেঁচে থাকতে চায়নি। অন্তর্বর্তী সরকার ‘দেশ-সংস্কার’ করবে, সারাদেশ আশায় বুক বেঁধে তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও দেশের মানুষ যার যার জায়গা থেকে নিজেকে সংস্কার না করতে পারলে ‘দেশ-সংস্কার’ অসম্ভব এবং অবাস্তব ব্যাপার।
আরও পড়ুনকিন্তু ‘দেশ-সংস্কার’ করতে যাওয়ার আগে তাঁদের ব্যাপারে ভাবতে হবে, যারা ' ‘দেশ-সংস্কারের’ সুযোগ এনে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে - নিহত ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজও সেটি সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। তাই বলবো, শহীদদের অনন্য মহিমার কাছে মুমূর্ষু আহতদের আর্তনাদ যেন গুরুত্বহীন এবং শ্রবণাতীত হয়ে না পড়ে।
শহীদদের পরিবারকে সম্মাননা জানানোর আগে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া ছিন্নভিন্ন এই মানুষগুলোর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা অধিক জরুরি। রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে নিহত-আহত সকল নাগরিকের পাশে। তার জন্য তাঁদের সঠিক সংখ্যা এবং বর্তমানে কে কী অবস্থায় আছে - তা নিরূপণ করা খুব জরুরি। মৃতদের এবং আহতদের পরিবারগুলো ভয়ঙ্কর এই ক্ষত বহন করে চলার পথে আর যেন নতুন বঞ্চনার হাহাকার প্রকাশ না করে।
তাদের জন্য নামমাত্র চিকিৎসার ব্যবস্থা করে বা সাময়িক এককালিন সহায়তা করে যেন দায় সারা না হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁদের জন্য যেন স্থায়ী, সম্মানজনক এবং ন্যায়ানুগ পুনর্বাসন-ব্যবস্থা করা যায়। শহীদদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়ার পাশাপাশি তাঁদের পরিবারগুলোকে যেন আর্থিকভাবে স্থায়ী-পুনর্বাসনের আওতায় আনা হয়। যারা গণহত্যার স্থায়ী-জখম নিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে বেঁচে থাকতে বাধ্য হবে, মৃত্যু পর্যন্ত রাষ্ট্র যেন তাঁদের দায়িত্ব নেয়।
নানান সংস্কারের ডামাডোলে তাঁদের বিষয়টি যেন চাপা পড়ে না যায়, এড়িয়ে যাওয়া না হয়। মৃত্যুর চেয়ে বিভীষিকাময় যে পঙ্গুত্ব, তার ভয়ানক লোমহর্ষক অন্ধকারেও তাঁরা বাঁচার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক সরবরাহ করা একটু আলো যেন পায়।
মোস্তফা আবু রায়হান
লেখক : কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
কাশিমাড়ী, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা
01921-567359
মন্তব্য করুন