রেলক্রসিং নিরাপদ হোক
পৃথিবীতে ট্রেনকে সবচেয়ে নিরাপদ যানবাহন ভাবা হয়। একই সঙ্গে ট্রেন ভ্রমণ সাশ্রয়ীও বটে। কিন্তু বাংলাদেশে ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা মোটেই নিরাপদ নয়। হরহামেশা দুর্ঘটনা ঘটছে। আর এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ অরক্ষিত রেলক্রসিং। সারা দেশে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে ২ হাজার ৫৪১টি রেলক্রসিং আছে। এর মধ্যে ২ হাজার ১৭০টিতে অর্থাৎ ৮৫ শতাংশেরই গেট বা যান নিয়ন্ত্রণ করার কোনো কর্মিও নেই। কুমিল্লায় একটি অবৈধ রেলক্রসিংয়ে একটি ট্রেনের ধাক্কায় ৭ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
গত মঙ্গলবার কুমিল্লায় রেল লাইনে আকস্মিকভাবে উঠে পড়া একটি অটোরিক্সাকে প্রায় আধা কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায় আন্ত:নগর সূবর্ণ এক্সপ্রেস। এর ফলে অটোরিকশার যাত্রী ছাড়াও ছয় আরোহীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে নাটোরের গুরুদাসপুর ও নীলফামারীর ডিমলায় পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় আরো সাতজনের প্রাণহানি ঘটেছে। এদের মধ্যে নিহতের সংখ্যা গুরুদাসপুরে চারজন এবং ডিমলায় তিনজন।
কুমিল্লার ঘটনায় আন্ত:নগর সূবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় ব্যাটারিচালিত একটি অটোরিকশা চূর্ণ বিচুর্ণ হয়ে গেছে। এতে অটোরিকশার সাতযাত্রী নিহত হয়েছেন। নিহতদের চারজন নারী। ট্রেনটি অটোরিকশাটিকে টেনে হিচড়ে অন্তত আধা কিলোমিটার নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে রিকশাটি খন্ড বিখন্ড হয়ে রেললাইনের পাশে পড়ে যায়। যাত্রীদের দেহের বিভিন্ন অংশ রেল লাইনের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এক বীভৎস দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।
গত মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের জেলার বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুর-বাকশিমূল সড়কের রেলক্রসিং এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয় লোকজন জানান, চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি দ্রুতগতিতে ঢাকা অভিমুখে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে জেলার বুড়িচং উপজেলার অবৈধ রেলক্রসিংয়ে একটি যাত্রী বোঝাই অটোরিক্সা হঠাৎ রেললাইনে উঠে পড়ে।
এ সময় দ্রুতগামী ট্রেনটি যাত্রীসহ রিকশাটিকে ধাক্কা দিয়ে টেনে নিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন দুর্ঘটনাস্থলে পৌছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। দুর্ঘটনাস্থলের আশে পাশে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাট-বাজার ও স্কুল, কলেজ-মাদ্রাসা থাকলেও ওই রেলক্রসিংয়ে কোনো গেট বা নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকায় এক সঙ্গে সাতটি প্রাণ ঝরে যায়।
রেলওয়ের দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশের বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে অনুমোদনহীন রেলক্রসিংয়ে। ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ১৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে রেলক্রসিংয়ে। এ ছাড়া অরক্ষিত ক্রসিংয়ে প্রায় সময় ট্রেনের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। আবার অনুমোদিত ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার কারণ জনবল সংকট। সংরক্ষিত ৭৮০টি ক্রসিংয়ে নিয়মিত গেট কিপার রয়েছে অর্ধেকেরও কম।
আরও পড়ুনতাই এসব ক্রসিংয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে কোনো কর্মি না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ ধরনের উদাসীনতা গ্রহণযোগ্য নয়। অবাক ব্যাপার যে, ট্রেন আসার আগে গেটবার (বেরিয়ার) ফেললেও পারাপারের সময় যানবাহন ও পথচারীরা অপেক্ষা করতে চায় না। রেলগেট তুলে ছোট যানবাহন ও মানুষ চলাচল করলেও গেটকিপার কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। অথচ রেলওয়ের আইন অনুযায়ী, রেললাইনের দুই পাশে ১০ ফুট করে মোট ২০ ফুট এলাকায় যে কোনো মানুষ প্রবেশ করলে তা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ।
অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা দিন দিন বাড়ার কারণে এসব ক্রসিংয়ে মানুষের প্রাণহানি ঘটছে, কোনো ধরনের প্রতিকারহীনভাবে। নিয়মিত গেটকিপার না থাকায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমানো যাচ্ছে না। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে গেটকিপার নিয়োগ দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। রেলক্রসিংগুলো যেখানে থাকার দরকার সেখানে নেই। যত্রতত্র ক্রসিং থাকা এবং মানুষের অসচেতনতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।
অবৈধ রেলক্রসিংয়ে যানবাহন পারাপারের দায়িত্ব রেল কর্তৃপক্ষের নয়। এসব দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে রেলওয়ের কোনো ধরনের দায়ভারও থাকে না। ফলে অবৈধ ক্রসিংয়ে মানুষ এবং যানবাহনকে নিজ দায়িত্বে পার হতে হয়। সারা দেশের অধিকাংশ রেলক্রসিংই অরক্ষিত।
খোদ রাজধানীর রেলক্রসিংগুলোতেও প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। অরক্ষিত রেলক্রসিং যেমন সুরক্ষিত রেলক্রসিংয়েও যানবাহন চালকদের অসতর্কতা, সিগন্যাল না মানা, তেমনি ক্রসিংয়ের গেট লাগানোর পরও যানবাহন নিয়ে পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। আমরা মনে করি, অরক্ষিত রেলক্রসিংগুলোর সুরক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি যানবাহন চালকদেরও সতর্ক হতে হবে এ ক্ষেত্রে।
মন্তব্য করুন