লোকচক্ষুর আড়ালে বগুড়া রেলওয়ে স্টেশন স্মৃতিস্তম্ভ অযত্ন, অবহেলায় মুছে যাচ্ছে শহিদদের নাম
হাফিজা বিনা : স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদদের বীরত্ব প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যাতে দেখে এবং তাদের বীরত্বে শ্রদ্ধা করে সেজন্য রাস্তা থেকে স্মৃতিস্তম্ভ দেখার জন্য প্রশস্ত একটা রাস্তা রাখা হয়েছিল। কিন্তু এখন মূল রাস্তা থেকে কিছুই দেখা যায় না। অস্তিত্ব হারাতে বসেছে বগুড়া স্টেশন রোডের বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ। অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠার কারণে লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকছে এই বধ্যভূমি।
বধ্যভূমিতে স্থাপিত শহিদদের নাম সংম্বলিত স্মৃতি ফলকটি থেকেও যে ক’জন শহিদদের নাম লেখা আছে তাও ঝাপসা হয়ে গেছে অনেকদিন। বাকি শহিদদের নাম স্মৃতিফলকে অন্তরভূক্ত করার দাবিও বহুদিনের। স্থানীয়রাসহ বগুড়া শহরে চলাচল করা মানুষরা জানেননা মুক্তিযুদ্ধের সময় কি নির্মম নির্যাতন করে শুধুমাত্র একদিনেই ২০জন মানুষকে ধরে এনে বগুড়া রেলস্টেশন এলাকার বধ্যভূমির পুকুরে এবং পুকুর পাড়ে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলে রেখে যায় পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদররা।
শহিদ পরিবারের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞের পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ৩০ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বগুড়া শহরের চক সুত্রাপুর এলাকায় হানা দিয়ে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে তৎকালীন মহা-হিসাব নিরিক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের পরিদর্শক আব্দুস সাত্তার, মাওলানা আব্দুল কাদের, আব্দুল সালাম, সমবায় সমিতির জেলা পরিদর্শক আব্দুল গণি,আব্দুল মতিন সুজা, মোহর আলী শেখ এবং অজ্ঞাত একজনসহ প্রায় ২০ জনকে ধরে এনে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সারা শরীর বীভৎস জখমের মধ্য দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে ফেলে রেখে যায়। এরপর সেই সময়ই শহিদ পরিবারের সদস্যরা ও স্থানীয়রা নিহতদের শনাক্ত করে সেখানেই কবর দিয়ে দেয়। কারণ হিসেবে তারা জানান,মরদেহগুলো সেখান থেকে নিয়ে যাওয়ার মত পরিস্থিতি ছিল না। স্বাধীনতার অনেক বছর পর এ স্থানটি বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিয়ের পর এই জায়গা সম্পর্কে তার স্বামীর কাছে শুনেছেন,রেলওয়ের ওই গণকবরে অন্তত: ২০ জন শহিদ রয়েছেন। হত্যাকান্ডের পর স্বজনরা এসে মরদেহগুলো শনাক্ত করেছিলেন। লাশগুলোর অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে তারা তাদের আপনজনের মৃতদেহগুলো নিয়ে যেতে পারেননি। পরে সেখানেই সেইসব শহিদদের গণকবর দেয়া হয়েছিল।
এই স্মৃতিস্তম্ভ সম্পর্কে তার মত স্থানীয় অনেকে জানান, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে এই বধ্যভ’মি ঘিরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। মানুষের চলাচলের জন্য সেসময় স্টেশন রোড থেকে স্মৃতিস্তম্ভ পর্যন্ত ২০ ফুট রাস্তাও রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে রাস্তার দু’পাশে ঘরবাড়ি, দোকানঘর নির্মাণ করে রাস্তা সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুনঅরক্ষিত স্মৃতিস্তম্ভে অনেকই বসে আড্ড দেন এবং সারাবছর বেদী এবং এর আশে পাশে অযত্ন,বিশৃঙ্খলা থাকলেও এখন বেদীটা পরিস্কার রাখা হয়েছে। শহিদ পরিবারের ক’জন আত্মীয়স্বজন নিজের খরচে স্মৃতিস্তম্ভের দুপাশে গাছ লাগিয়েছেন, সংকুচিত ওই রাস্তা পাকা করেছেন। প্রতিদিন টাকা দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভের বেদী ও সামনের রাস্তা পরিস্কার করার লোক রেখেছেন। মাঝে মাঝে বেদীর ইট সিমেন্ট খুলে গেলে তাও ঠিক করে দেন নিজের উদ্যোগে।
এব্যাপারে শহিদ আব্দুস সালাম ও আব্দুল গণির ভাগনে আশরাফুল কবির জনি বলেন, ৭১ সালে তার তিন মামাকেই হানাদার বাহিনী ধরে একসাথে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বধ্যভ’মিতে। শক্ত আঁটুনির বাঁধন একটু আলগা পেয়ে ছোট মামা আব্দুল বাচ্চা অন্ধকারে হানাদার বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেঁচে যান। পরবর্তীতে মামার কাছ থেকে এই নির্মম, নিষ্ঠুর বর্ণনা শুনেছেন তিনি। তিনি বলেন, নিজের আত্মার তাগিদ থেকেই অনেকদিন হলো আরও একজন শহিদ পরিবারের সদস্যর দেখাদেখি এই স্থানটি পরিস্কার করছি। গাছ লাগিয়েছি, যাতে এখানে এই স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে আসা মানুষরা ছায়া পান এবং সেই সাথে এখানে শুয়ে থাকা দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ দেয়া শহীদদের আত্মা শান্তি পায়।
তিনি রেলওয়ে কলোনীতে শহিদ হওয়া সমস্ত শহিদ পরিবারের পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে দাবি জানান, দেশে এখন সব সেক্টরে সংস্কার চলছে। দেশ মাতৃকার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভটি অতিদ্রুত সংস্কার করা দরকার। সেই সাথে সেদিন এখানে যে ২০ জন শহিদকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল তাদের সবার নাম স্মৃতিস্তম্ভে সন্নিবেশিত করতে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেছেন শহিদ পরিবারের এই আত্মীয়। এছাড়াও এই শহিদ বেদীর চারপাশে এসএস পাইপ দিয়ে ঘেরা দিয়ে মূল স্মৃতিস্তম্ভের সংস্কার করে দেয়া হয়।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বগুড়া জেলা ইউনিট কমান্ডের সাবেক কমান্ডার রুহুল আমিন বাবলু জানান, এ বধ্যভূমি দীর্ঘদিন অবহেলিত ও চোখের আড়ালে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। বছরের ২৬ মার্চ এবং ১৬ ডিসেম্বর এলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহিদদের কবরে ফুল দেয়া হয় অনেকটা দায়সারা ভাবে। তারপর সারা বছর যা তাই। দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ দেয়া এই বীর শহিদদের জন্য আমরা ন্যূনতম একটা বাজেট রাখিনা। এটা যেন ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’র মত অবস্থা।
মন্তব্য করুন