অযত্ন-অবহেলায় বগুড়ার সর্ববৃহৎ গণকবরটি এখন শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠ
শাওন রহমান : কেটে গেছে বিজয়ের ৫৩ বছর। মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি শক্তি বাঙালি নিধনে যে নির্বিচার হত্যাকান্ড চালায় তার নির্মম সাক্ষি দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য গণকবর ও বধ্যভূমি।
বগুড়ার ১২টি উপজেলার ৩৫টি গণকবর ও বধ্যভূমিতে রয়েছে হাজারও মানুষের লাশ।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মম হত্যাকান্ড চালিয়ে এসব মানুষকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয় বা ফেলে রেখে যায়। ২০১৮ সালে তৎতকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী জেলার প্রতিটি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে কয়েক দফা চিঠি দিয়ে বগুড়ার গণকবর ও বধ্যভূমির তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করেন।
তাদের পাঠানো তথ্যমতে, বগুড়া সদরের মোট ৫টি গণকবর ও বধ্যভূমিতে ৩১৬ জন মানুষকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয় বা মাটিচাপা দেওয়া হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ২৩০ জন মানুষের লাশ রয়েছে শহরের নারুলী-চেলোপাড়া গণকবরে। বগুড়ার সর্ববৃহৎ এই গণকবরে আজ পর্যন্ত কোন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত না হওয়ায় প্রায় বিস্মৃতির পথে মহান মুক্তিযুদ্ধের নির্মম স্মৃতিবহ স্থানটি। এটি এখন স্থানীয় শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠ, আর ময়লা-আবর্জনা ফেলার স্থান।
বিজয়ের ২৪ বছর পর ১৯৯৫ সালে পরিত্যক্ত ময়লার ভাগারটিকে গণকবর হিসেবে চিিহ্নত করা হয়। পরবর্তীতে মাটি ভরাটের পরের বছরই মেলে গণকবরটির সরকারি স্বীকৃতি। জেলা পরিষদের উদ্যোগে বিগত ২০১৫ সালের দিকে জায়গাটিকে ইটের প্রাচীর ও লোহার গ্রিল দিয়ে সীমানা করে দেওয়া হয়। পরে আরেকবার মাটি ভরাটের পর জায়গাটি এখন খোলার মাঠের রূপ পেয়েছে।
গণকবরটির সামনে ক্ষয়ে যাওয়া রুগ্নাবস্থায় একটি নামফলক থাকলেও বর্তমানে সেটিরও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল। গণকবরটির দেয়ালজুড়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের চিত্র আঁকা থাকলেও তাও মুছে গেছে। সবমিলে জায়গায়টি যে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত গণকবর তার কোন চিহ্নই নেই। এছাড়াও গণকবরটির মধ্যে ফুটবল খেলার জন্য মিনি গোলবার তৈরি করে নিয়মিত ফুটবল খেলছেন স্থানীয় শিশু-কিশোররা। আর এরমধ্যে প্রবেশের একমাত্র গেটের মুখে নিয়মিত ফেলা হয় ময়লা-আবর্জনা।
আরও পড়ুনস্থানীয়রা বলছেন, প্রতিদিন এখানে স্থানীয় শিশু-কিশোররা খেলাধূলা করছেন। শিশুরা না জানলেও যারা জানে তারাও গণকবরের গুরুত্ব মানতে চান না। আর সকাল-বিকেল আশেপাশের বাসা-বাড়ির ময়লা, আবর্জনা ফেলা হয় এর গেটের সামনে। তাদের অভিযোগ, সরকারের কোন বিভাগ বা স্থানীয় প্রশাসনের কোন পদক্ষেপ বা গুরুত্ব না থাকায় এটি এখন বিস্মৃতির পথে।
এদিকে ২০২০ সালে বগুড়া জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ডা. মকবুল হোসেন জানিয়েছিলেন, গণকবরটিতে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দও দেওয়া হয়। তবে সরকারিভাবে গণপূর্ত বিভাগ বগুড়ার অধীনে এখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের মৌখিক প্রস্তাবনার কথা জানানো হলে জেলা পরিষদ স্থানটিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ থেকে সরে আসে।
সরকারিভাবেই জায়গায়টিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কথা জানিয়েছিলেন গণপূর্ত বিভাগ বগুড়ার তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. বাকী উল্লাহ। তবে জায়গাটি রেল কর্তৃপক্ষের হওয়ায় তাদের অনুমোদন-অনুমতি ছাড়া ওই জায়গায় কোন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
বগুড়ার সর্ববৃহৎ এই গণকবরে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে কোন পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী মোহায়েদুল ইসলাম বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এধরনের নির্মাণ পরিকল্পনার কোন বাজেট বরাদ্দ নেই। আগামীতেও এখানে কোন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে কিনা এমন তথ্যও তার কাছে নেই।
মন্তব্য করুন