সময়মত বিয়ে নাকি পরে উত্তম
ছোট বেলায় নানা দাদা ফুপু খালাদের বাসায় বেড়াতে গেলে মনটা খুশিতে ভরে যেত। ওনাদের হাসি মাখা মুখ, সাজান সংসার দেখলে মনে হত পৃথিবীর সমস্ত সুখ ওনাদের জীবনে আছড়ে পড়ছে। ওনাদের মাঝে কুসুম কুসুম প্রেম একে অন্য্যকে শ্রদ্ধা সম্মান লাজুক লাজুক চাহনি প্রতিটা মুহূর্তকে প্রাণবন্ত করে রাখত।
দাদী দেশি মুরগী খোপ হতে টেনে বটি হাতে দাদাকে গিয়ে বলতেন কুটুম এসেছে জবাই করুন তাড়াতাড়ি খাবার দিতে হবে। কখনও নানি বালতি হাতে লম্বা ঘোমটায় গোয়াল ঘরে নানার জন্য ঠাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন। রাগ অভিযোগ বিরক্ত দূরে থাক নানা যখন গরুকে নিয়ে গোয়াল ঘরে প্রবেশ করতেন নানি অধির আগ্রহে বালতি, তেলের বাটি পরম যত্নে নানার হাতে তুলে দিতেন। নানির শ্রদ্ধা বিচলিত দেখে নানা মুচকি হাসতেন।
ওনাদের বয়স একে অন্য হতে ২০ থেকে ২৫ বছর কম বেশি ছিল, শিক্ষা দিক্ষায় একে অন্য হতে দিন রাত ব্যবধান ছিল, আপনি বলে সম্বোধন করতেন, ওনাদের ঘর ভর্তি সন্তান ছিল, দুজনার দুটি চৌকি দেখতাম ঘুমানোর জন্য। দাদা খাবার খেতে বসলে পাখার বাতাস করত দাদি। কোন দিনও ওনাদের মাঝে মনোমালিন্য ঝগড়া বিবাদ কলহ শোনা যায়নি।
নানা বাজারে গেলে নানি চৌকাঠে বসে উঠোনের দিকে তাকিয়ে থাকতেন কখন নানা ফিরবেন, নানা ফিরলে নানির মুখে গোলাপী আভায় স্নিগ্ধ বাতাসে প্রজাপতি খেলা করত। মৃদু বাতির নিভু নিভু আলোতে ফুপু ফুপার হাতে পান গুজে দিয়েই লজ্জায় লাল পালিয়ে যেতেন।
মাটির চুলায় খালা যখন পাঁচ ফোড়নে মাতোয়ারা সুগন্ধে হালকা জাল ঠেলে কুয়াতে দড়ি নামিয়ে কলসি তুলছেন খালু তখনি নিভু চুলাতে এক মুঠো পাটকাঠি গুজে ফুকনিতে ফু দিতে থাকেন। ওনাদের মাঝে মিল অমিলের সুক্ষ্ম সুতায় বুনন করা সুবাসিত ফুলের মালা গলায় দিয়ে বিয়ে হতে মৃত্যু পর্যন্ত একে অন্যকে আগলে রাখতেন। এক জনের মৃত্যুতে অন্যজন দিশেহারা শোকের পাথর বুকে বেধে বেহুস বাকিটা জীবন কাটাতেন।
তখনকার দিনে এতো বিবাহ বিচ্ছেদ ছিল না। পরকিয়া, খুন, একে অন্যের সাথে পালিয়ে যাওয়া, দাম্পত্য কলহ, সালিস বিচার জেল জরিমানা কলংকিত করতো না একে অন্যকে। বাবা মা, মুরব্বিজনেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে সেকালে বিয়ে সম্পর্ণ করাতেন। অভিভাবকদের মতের বিরুদ্ধে কেউ যেতেন না কারণ অভিভাবকদের সম্মান শ্রদ্ধা করতেন, ওনাদের সিদ্ধান্ত নিশ্চয় সঠিক মনে বিশ্বাস রেখে সংসার করতেন।
এখনকার দিনে ছেলে মেয়ে উভয় উচ্চ শিক্ষিত। অভিভাবকেরা ছেলে মেয়েদের জন্মের আগেই সিদ্ধান্ত নেয় ডাক্তার বানাবেন নাকি ইন্জিনিয়ার। অভিভাবকদের শখ আশা স্বপ্ন পূরন করতে ছেলে মেয়েরা হিমসিম বিয়ের বয়স পার করে সেকালে গিয়ে ভাবতে থাকে কখন বিয়ে করবে, কখন সন্তান জন্ম দিবে, কখন মানুষ করবে? সেই ভাবনায় চুলে পাক ধরে।
আরও পড়ুনঅভিভাবকরা তখন উচ্চ শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের জন্য উচ্চ শিক্ষিত পাত্র পাত্রী খুঁজতে খুঁজতে হতাশ, যদিও অবশেষে খুঁজে পান কর্ম ব্যস্ততায় ছেলে মেয়েরা ক্লান্ত প্রায় বিবাহিত জীবনের মর্ম আনন্দ দায়িত্ব কর্তব চর্চার চেয়ে পেশাগত জীবনের দায়িত্ব পালনে মজে থাকে। অর্থ সম্পদ গাড়ি বাড়ি অর্জনে ডুবে থাকে। কেননা ছেলে মেয়েরা স্বভাবগত ভাবেই একসাথে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ, কর্মস্থলে যোগদান, অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে একে অন্যের সংস্পশে আসবেই।
আগুনে কখনও মোম গলে না এমন অবা¯তব ঘটনা বিরল। বহু পথ একে অন্যের সাথে পাড়ি দিতে গিয়ে মনে কমপিয়ার দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভাললাগা ভালবাসা দানা বাধতে পারে। যার প্রভাব পড়ে বিবাহিত জীবনে। নিছক তুচ্ছ মূল্যহীন মনে হয় বিবাহিত জীবন সঙ্গীকে। বরং একঘেয়ামি বোঝা মনে হয় অত:পর মনোমালিন্য দ্বন্দ্ব কলহ বিচ্ছেদ অনিবার্য ফলাফল ভোগ করে সন্তান পরিবারের সদস্যরা।
কিছুদিন যেতে না যেতেই অভিভাবকদের নতুন ভাবনা সমাজ কি বলবে? সন্তানের ভবিষ্যৎ কি হবে? এভাবে দিনশেষে ভাললাগা ভালবাসা দোষ ত্রুটির মিশ্র প্রতিক্রিয়া পরকিয়ায় রূপ নেয়। সংসার জীবন তখন বড্ড একঘেয়ামি লাগে। এভাবে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ আর পরকীয়া। নেশার মত ছুটছে মানুষ ভুল পথে। পরিণাম ধ্বংস অনিবার্য ধ্বংস। সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে আমার প্রশ্ন সময়মত বিয়ে নাকি প্রতিষ্ঠিত হয়ে পরে বিয়ে উত্তম?
তাসলিমা পারভীন
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (প্রয়াস)
মন্তব্য করুন