প্রতি পূর্জি হাজার টাকায় বিক্রির অভিযোগ
নাটোরের নর্থবেঙ্গল চিনিকলের নিজস্ব জমিতে আখের পরিবর্তে চাষ হচ্ছে আলু-মশুর ডাল
নাটোর প্রতিনিধি : দেশের সবচেয়ে প্রাচীন নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুর নর্থবেঙ্গল চিনিকলের পূর্জি বিক্রি নিয়ে অসাধু সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি চিনিকলের নিজস্ব জমি প্রকৃত আখ চাষীদের মাঝে লিজ প্রদান না করায় সেখানে আখের পরিবর্তে চাষাবাদ হচ্ছে আলু ও মশুর ডাল।
এছাড়া চিনিকলে আখ সরবরাহ ও ওজনে কারচুপি নিয়েও রয়েছে নানা অনিয়ম। এজন্য চিনিকলের কর্মকর্তাদের অব্যবস্থাপনা ও স্বজনপ্রীতিকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চিনিকল কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয় আখ চাষীদের অভিযোগ, চিনিকল চালু হওয়ার পর থেকে সাধারণ আখ চাষীরা চিনিকলে আখ সরবরাহের জন্য সঠিকভাবে পূর্জি (চিনিকলের আখ সরবরাহপত্র) পাচ্ছেন না। বিনামূল্যে সরবরাহের এই পূর্জি অসাধু ব্যক্তিদের কাছ থেকে তাদের ৭০০ থেকে হাজার টাকায় কিনে চিনিকলে আখ সরবরাহ করতে হচ্ছে। আবার সেখানে ওজনে বড় ধরনের কারচুপিরও অভিযোগ রয়েছে। ফলে ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূর থেকে আখ নিয়ে জেলা সদরের নাটোর চিনিকলে সরবরাহ করছেন কৃষকরা।
নর্থবেঙ্গল চিনিকল সূত্রে জানা যায়, এই চিনিকলের আখ চাষাবাদের জন্য নিজস্ব চার হাজার ৯৫১ একর নিজস্ব জমি রয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ২৬ একর জমি স্থানীয় কৃষকদের মাঝে চাষাবাদে তিন মাসের জন্য লিজ দেয়া আছে। বাকী জমি কৃষি খামারের মাধ্যমে আখ চাষ করা হয়। যা চিনিকল চালু হলেই কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয় করা হয়। পরবর্তীতে একই জমি আখ উত্তোলনের পর অন্যান্য ফসল উৎপাদনে লিজ প্রদান করা হয়। যেখান থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাওয়া যায়। চিনিকল কর্তৃপক্ষ জানায়, মিল গেইটে প্রতি পূর্জিতে ১ হাজার ৫০ কেজি আখ এবং বাইরে ১ হাজার ২০০ কেজি আখ ক্রয় করা হয়।
তবে এবিষয়ে স্থানীয়দের অভিযোগ, লিজ গ্রহিতারা চিনিকলের এসব জমিতে আখ চাষ না করে বেশি লাভের আশায় আলু ও মশুর ডাল চাষাবাদ করছেন। আর এখানে প্রকৃত চাষীদের না দিয়ে নিজের কাছের মানুষদের কাছে এসব জমি লিজ দেয়ার অভিযোগ যুগযুগ ধরে চলে এলেও কোন প্রতিকার মেলে না। ফলে চিনিকলের জমির সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। তাদের দাবি-এসব জমিতে আলু-মশুর ডাল চাষাবাদ না করে আখের চাষাবাদ করলে আরও অধিক পরিমাণ আখ উৎপাদনের পাশাপাশি চিনিকলের আখের চাহিদা মিটিয়ে অন্যত্র সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
আখ চাষীরা বলছেন, এই অনিয়মের সাথে চিনিকলের অনেকেই জড়িত আছেন। তবে বরাবরের মতই সংশ্লিষ্টরা এ সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। গত ১৫ নভেম্বর দুই লাখ টন আখ মাড়াই করে ১১৭ আখ মাড়াই দিবসে ১৫ হাজার টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে চলতি মৌসুমে এই চিনিকলের মাড়াই মৌসুম উদ্বোধন করা হয়।
এরপর থেকেই পূর্জি সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা মিল থেকে নির্ধারিত মূল্যে পূর্জি কিনে কৃষকদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করছেন। এনিয়ে স্থানীয় কৃষকসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন দানা বেঁধেছে।
নর্থবেঙ্গল চিনিকলের তালিকাভুক্ত আখ চাষী ও লালপুর উপজেলার আড়বাব ইউনিয়নের সাইপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, এবার তিনি সাত বিঘা নিজের ও ১৩ বিঘা অন্যের জমি লিজ নিয়ে আখ চাষাবাদ করেছেন। বেশির ভাগ লিজ নেয়া জমিতে আখ চাষ করায় তাকে পূর্জি দেয়া হয় না। স্থানীয় মাধবপুর সাব সেন্টারে গিয়ে তিনি পূর্জি পাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্ত দালালদের ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা না দিলে কোন পূর্জি দেয়া হচ্ছে না।
দিলালপুর গ্রামের শ্রী বিপ্লব কর্মকার জানান, তিনি ৩০ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছেন। নর্থবেঙ্গল চিনিকলে প্রতি মণ আখ সরবরাহ করতে তার ভাড়া খরচ হয় ১০ টাকা আর নাটোরে খরচ হয় ৩৫ টাকা করে। তারপরও দালাদের কাছ থেকে হাজার টাকায় পূর্জি কেনার হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি নাটোর চিনিকলে আখ সরবরাহ করছেন। গত বুধবার তার এলাকার সিআইসি (চিনিকলের স্থানীয় কর্মকর্তা) তাকে আগামী ১০ থেকে ১৫দিনেও কোন পূর্জি দিতে পারবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। পূর্জি না পাওয়ায় জমি থেকে সময়মত আখ কর্তন করতে পারছেন না।
এতে এসব জমিতে রবিশস্য চাষাবাদ করা নিয়ে দু:শ্চিন্তায় আছেন তিনি। তাই বাধ্য হয়ে লালপুর থেকে নাটোরে এনে আখ সরবরাহ করেন। একই উপজেলার কেশবপুরের আখচাষী সাহাজুল ইসলাম জানান, ১০ বিঘা জমিতে তিনি আখ চাষ করেছেন। তার এখন ৬০ থেকে ৭০টি পূর্জি প্রয়োজন। নর্থবেঙ্গল চিনিকল থেকে গত এক মাসে তাকে মাত্র দুটি পূর্জি দেয়া হয়েছে। পূর্জি না পাওয়ায় তিনি নাটোর চিনিকলে আখ সরবরাহের চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই বিভিন্ন মহলের চাপে নাটোর চিনিকলও চিনিকল এলাকার বাইরের আখ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে আখ বিক্রি নিয়ে বেকায়দায় আছেন তিনি।
এসব অভিযোগ সর্ম্পকে জানতে বৃহস্পতিবার বিকেলে গোপালপুর নর্থ বেঙ্গল চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ খবির উদ্দিন মোল্ল্যার সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনি জানান, প্রাপ্য চাষীদের পূর্জি দেয়ার পর কোন কারণে তিনি বিক্রি করলে তার দায় তো চিনিকলের নয়। চিনিকলের কেউ এমন কান্ডে জড়িত নয় এবং ওজনে কারচুপির অভিযোগও সঠিক নয়।
নর্থবেঙ্গল চিনিকল এলাকায় উৎপাদিত আখ চাষীরা নাটোর চিনিকলে সরবরাহের বিষয়ে তিনি দাবি করে বলেন, এ বিষয়ে সমস্যার সমাধানের জন্য আজই (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যার দিকে চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন সকল চিনিকল এবং সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের সাথে জুম মিটিং আহবান করছেন।
চিনিকলের জমিতে আখের পরিবর্তে আলু-মশুর ডাল চাষের বিষয়ে তিনি বলেন, শুধুমাত্র রবিশস্য চাষ করার জন্যই তিন মাস মেয়াদে এসব জমি লিজ দেয়া হয়। তাই লিজ গ্রহিতারা নিয়ম মেনেই সেখানে রবিশস্য চাষ করেন। এতে কোন অনিয়ম বা যোগসাজসের অভিযোগ সঠিক নয় বলে তিনি দাবি করেন।
মন্তব্য করুন