লোকসানের বোঝা নিয়ে দর্শনা চিনিকলে আখ মাড়াই শুরু
নিউজ ডেস্ক: ২০২৪-২৫ আখ মাড়াই মৌসুম শুরু করতে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় চিনিকল চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কেরু এ্যান্ড কোম্পানি। চিনিকল ইউনিটে ৬১ কোটি ৭ লাখ টাকা লোকসানের বোঝা নিয়েই চালু হতে যাচ্ছে কারখানাটি।
শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) বিকেলে চিনিকলের কেইন কেরিয়ারে আখ নিক্ষেপের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এবারের মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান লিপিকা ভদ্র।
এ সময় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কেরু চিনিকলের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাংলাদেশ চিনিকল শ্রমিক ও কর্মচারী ফেডারেশনের নের্তৃবৃন্দসহ আখচাষি ও সূধীজন উপস্থিত থাকবেন। সবকিছু ঠিকঠাক চললে চিনিতে মোটা অংকের লোকসান কমিয়ে আনতে পারবে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি এমনটিই আশা কর্তৃপক্ষের।
১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের সবচেয়ে বড় চিনিকল দর্শনা কেরু এ্যান্ড কোম্পানি। চিনি উৎপাদন কারখানা, ডিষ্টিলারী, জৈব সার কারখানা, বাণিজ্যিক-পরীক্ষামূলক খামার ও ওষুধ কারাখানার সমন্বয়ে গঠিত বৃহৎ এ শিল্প কমপ্লেক্সের চিনি কারখানাটি দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহতভাবে লোকসান গুণে আসছে। সরকারিভাবে চিনির মূল্য বৃদ্ধির কারণে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে কারখানাটি।
প্রায় ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে মিলস হাউজে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন করে চিনিকলটি আধুনিকায়নের কাজ চলছে। এতে আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়বে। তবে এলাকায় আখ চাষ ক্রমাগত কমতে থাকায় সংকটে পড়েছে দেশের ঐতিহ্যবাহী এ চিনিকলটি।
চলতি মৌসুমে প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৪ হাজার ৪শ’ ৫২ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ৬৫ দিন চলবে এবারের মাড়াই মৌসুম। চিনি আহরণের হার ধরা হয়েছে শতকরা ৬ দশমিক ৩৬ ভাগ। প্রতিদিন গড়ে ১১শ’ ৫০ টন আখ মাড়াই করবে চিনিকলটি। মিল জোনে এবার দন্ডায়মান আখ রয়েছে ৫ হাজার ১শ’ একর জমিতে।
গত ২০২৩-২৪ মৌসুমে ৬৫ হাজার টন আখ মাড়াই করে ৪ হাজার টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। মোট ৫৫ মাড়াই দিবসের লক্ষ্যমাত্রায় চিনি আহরণের গড় হার ধরা হয়েছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। এর বিপরীতে চিনিকলটি ৫৬ হাজার ৪শ’ ১৪ মে. টন আখ মাড়াই করে ২ হাজার ৬শ’ ৮ টন চিনি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। চিনি আহরণের হার ছিল ৪ দশমিক ৬২ ভাগ। আখের অভাবে নির্ধারিত দিবসের আগেই মাড়াই মৌসুম বন্ধ হয়ে যায়।
চিনিকলের শ্রমিকরা জানায়, এ বছর মিলস হাউজের ফিটিংয়ের কাজ ভালো হয়েছে। মিল ভালই চলবে। ফলে বেশি চিনি উৎপাদন সম্ভব হবে।
কেরু এ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাব্বিক হাসান জানান, মাড়াই মৌসুম শুরু করতে চিনিকলের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এ মৌসুমে চিনি কারখানায় লোকসান কমিয়ে আনতে সবাই মিলে কাজ করছে। এ ছাড়াও এ মৌসুমে কোদাল দিয়ে আখ কাটার পদ্ধতি চালু করা হবে। এতে কয়েক হাজার টন আখ বেশি পাওয়া যাবে। চিনির উৎপাদনের পরিমানও বাড়বে।
আরও পড়ুনচাষিদের দাবির প্রেক্ষিতে এ মৌসুমে আখের মূল্য বাড়িয়েছে সরকার। এবার প্রতিমন (৪০ কেজি) আখের মূল্য ২৫০ টাকা করা হয়েছে। তবে চিনির মূল্য বাড়লেও আশানুরূপ হারে আখের মূল্য বাড়েনি। আখের মূল্য আরও বাড়ানোর দাবি চাষিদের।
কেরু চিনিকল আখচাষি কল্যাণ সংস্থার সভাপতি মো. শরীফ উদ্দীন জানান, চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাছে আখচাষিদের এবার দাবি, চাষিদের মাঝে আখ বিক্রির পুজির পরিমান বাড়াতে। আখের মূল্য সরাসরি নগদে পরিশোধ করতে। শিওর ক্যাশ বা বিকাশে চাষিরা টাকা নেবে না।
ঋণের সার, বীজ, কীটনাশক সঠিক সময়ে দিতে হবে এবং চাষিদের কোটায় পাওনা চিনি উত্তোলনের সময় বাড়াতে হবে। মাড়াই মৌসুম আরও আগে শুরু করতে হবে। নভেম্বর প্রথমেই আখ মাড়াই শুরু করতে হবে। আখের দাম নূন্যতম প্রতিমন ৩শ’ টাকা করতে হবে। চাষিদের কাছ থেকে কেটে নেয়া টাকা সম্পূর্নটাই আখচাষি কল্যাণ সংস্থায় জমা করতে হবে।
প্রসঙ্গত, ১৮০৫ সালে মি. জন ম্যাকসওয়েল নামক এক ইংরেজ তার ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় ভারতের কানপুরে জাগমু নামকস্থানে তখনকার একমাত্র ফরেন লিকার কারখানাটি চালু করেছিলেন। অতঃপর বিভিন্ন সময়ে এর নাম, স্থান, মালিকানা, উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কর্মকান্ড পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হতে থাকে। ১৮৪৭ সালে মি. রবার্ট রাসেল কেরু অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ঐ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন এবং কালক্রমে তা ক্রয় করে নেন।
উত্তর ভারতের ‘রোজা’তে অবস্থানকালীন ১৮৫৭ সনে সিপাহী বিপ্লবের সময় কারখানাটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অতঃপর তা পুনঃনির্মাণ পূর্বক জয়েন্ট ষ্টক কোম্পানি গঠন করে ‘কেরু এ্যান্ড কোম্পানী লি. হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির নতুন নামকরণ করা হয়। ‘রোজা’তে ব্যবসা উন্নতি লাভ করলে আসানসোল ও কাটনীতে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৮ সালে প্রাথমিকভাবে দৈনিক ১০০০ টন আখ মাড়াই ও ১৮ হাজার প্রুফ লিটার স্পিরিট তৈরির লক্ষ্যে আরও একটি শাখা তদানীন্তন নদীয়া জেলার অন্তর্গত এ দর্শনায় স্থাপন করা হয়।
১৯৬৮ সনে ইংরেজরা এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর কেরু এ্যান্ড কোম্পানী (পাকিস্তান) লি. এর স্থলে ব্যবস্থাপনা দায়িত্ব ইপিআইডিসি’র উপর ন্যস্ত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণ করা হয়। তখন থেকে অদ্যাবধি এটি কেরু এ্যান্ড কোম্পানী (বাংলাদেশ) লি. নামে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে কেরু এন্ড কোম্পানি বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব খাতে জমা দিয়েছে সর্বোচ্চ ১৪৫ কোটি টাকা। এ বছর রাজস্বের পরিমান দাঁড়াবে প্রায় ২০০ কোটি। কেরু এ্যান্ড কোম্পানীর ৬টি ইউনিটের মধ্যে ৫ টি ইউনিট- ডিস্টিলারী, জৈব সার কারখানা, বাণিজ্যিক খামার, পরীক্ষামূলক খামার, ফার্মাসিটিক্যাল- আয়কর বাদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১১২ কোটি ৭ লাখ টাকা মুনাফা করেছে। কেবলমাত্র চিনিকল ৬১ কোটি ৭ লাখ টাকা লোকসানে রয়েছে।
মন্তব্য করুন