ড্রেজার মেশিন নষ্ট তিন বছর
বোমা মেশিনে চলছে তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের সিলট্রাপ খনন কাজ
ডিমলা (নীলফামারী) প্রতিনিধি : তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের সিলট্রাপ খনন নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। ড্রেজার মেশিন তিন বছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকায় শ্যালোচালিত বোমা মেশিন দিয়ে খনন করা হচ্ছে। এতে পরিপূর্ণতা পাচ্ছে না খনন কাজ।
পাউবো ও ঠিকাদারের অবহেলায় হুমকির মুখে তিস্তা ব্যারাজ ও সরকারি বাংলো। বোমা মেশিন দিয়ে সিলট্রাপ খননের ফলে ব্যারেজ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, তিস্তা ব্যারাজ, সেচ প্রকল্প, সরকারি পরিদর্শন বাংলোসহ নদী তীরবর্তী স্থাপনা ও পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মক ঝুঁকির আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের পর ১৯৯৩ সাল থেকে সেচ সরবরাহ করছে। ৬১৫ মিটার দীর্ঘ ব্যারাজ উত্তরে ভারতের উজান থেকে আসা পানি আটকে দেয়। ব্যারাজে ৪৪টি গেট আছে। উজানের পানি বেশি থাকলে বেশিসংখ্যক গেট খুলে দেওয়া হয়। পানি আসা কমতে থাকলে এক এক করে সব গেট বন্ধ করা হয়।
উজানের ভারত থেকে আসা নদীর পানি বাংলাদেশ অংশের তিনবিঘা করিডোর দহগ্রাম থেকে পূর্বছাতনাইয়ের কালিগঞ্জ হয়ে ডালিয়া পর্যন্ত এই ১৯ কিলোমিটার সেচের পানির আধার বা রিজার্ভার হিসেবে কাজ করে। এই আটকানো পানি সেচের জন্য নেয়া হয় আটটি রেগুলেটর গেট দিয়ে সিলট্রাপে। তারপর সিলট্রাপ নদীর কাঁদা বা ময়লা পানি নেটের জালে ছেঁকে স্বচ্ছ করে ক্যানেলে ছাড়া হয়।
তিনটি জেলা নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুরের ১২টি উপজেলায় জালের মতো ছড়িয়ে আছে প্রকল্পের খাল। এর মধ্যে আছে প্রধান খাল (৩৩ কিলোমিটার), মেজর সেকেন্ডারি খাল (৭৪ কিলোমিটার), শাখা খাল (২১৫ কিলোমিটার), উপশাখা খাল (৩৮৮ কিলোমিটার) এবং নিষ্কাশন খাল (৩৮০ কিলোমিটার)।
তিস্তা সেচের সুবিধাভোগী কৃষকদের অভিযোগ তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকে সিলট্রাপ ডেজিং করা হতো বিদেশ থেকে নিয়ে আসা ড্রেজার মেশিনের মাধ্যমে। এতে সিলট্রাপের গভীরতা ও ক্যানেলের পানি সরবরাহ ভালো হতো। অথচ গত তিন/চার বছর থেকে সেই ড্রেজার মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
ফলে কৃষকরা দেখেছেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে নদী-খাল-পুকুর খনন প্রকল্পের আওতায় সিলট্রাপসহ চারটি পুকুর খনন কাজ চলছে বোমা মেশিন বসিয়ে। এবারও চলতি মৌসুমে বোরো ধান আবাদে আগামী ১৫ জানুয়ারি থেকে সেচ কার্যক্রম শুরু হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সেচ দিবে ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে। কিন্তু সিলট্রাপ ভরাট থাকায় ড্রেজার মেশিন ছাড়াই তড়িঘড়ি করে বোমা (শ্যালো) মেশিনের মাধ্যমে খনন করা হচ্ছে। এতে সিলট্রাপ পরিপূর্ণভাবে খনন হচ্ছে না বলে অভিযোগ কৃষকদের।
সরেজমিনে গেলে বেশকিছু কৃষক দেখিয়ে বলেন, সিলট্রাপ খনন করা হচ্ছে পাঁচটি বোমা মেশিন দিয়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন জানালেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নদী-খাল-পুকুর খনন প্রকল্পের আওতায় তিস্তার সেচ প্রকল্পের প্রধান খালে (সিলট্রাপ) সেচ ক্যানেলে জমে থাকা পলিমাটি অপসারণে খনন কাজ শুরু করে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড।
আরও পড়ুনবরাদ্দ ২৯ লাখ টাকা। খনন করছে মেসার্স সাইকি বিল্ডার্স নামে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যেই খননের বালু উত্তোলনের জায়গাগুলোতে তৈরি হয়েছে গভীরতা। অন্যদিকে উত্তোলিত বালু তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে ফেলা হচ্ছে, যা নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কারণে সেচ ক্যানেলের পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রায় চার সপ্তাহ ধরে তিস্তা ব্যারাজ ২শ’ মিটার দূরত্বে চলছে সেচ ক্যানেলের খনন। ফলে ক্যানেলের তলদেশে প্রায় ২৫-৩০ ফুট গভীরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আশপাশের স্থাপনাগুলোর স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। এতে ক্যানেলের দুই পাড় দেবে বাঁধ ও সিসি ব্লক ধসে যেতে পারে।
এ ব্যাপারে পাউবো’র উত্তরাঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, তিন বছর ধরে ড্রেজার মেশিন নষ্ট। বিদেশ থেকে ড্রেজার মেশিন আনতে টেন্ডার করা হয়, সেটি বাতিল হলে পুনরায় টেন্ডার করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, যেহেতু ড্রেজার মেশিন নষ্ট তাই বিকল্প পদ্ধতিতে (বোমা মেশিন) জরুভাবে সিলট্রাপ খনন করা হচ্ছে। তবে এভাবে সম্পূর্ণ সিলট্রাপ খনন সম্ভব নয়।
তাই পাথমিকভাবে আড়াইশ’ মিটার এলাকা খনন করা হচ্ছে। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, আগামী ১৫ জানুয়ারি থেকে বোরো ধানে সেচ দিতে হবে। এই খননে বরাদ্দ কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোন বরাদ্দ নেই। জরুরিভাবে ঠিকাদার নিয়োগ করে খনন কাজ করা হচ্ছে। বরাদ্দ এলে ঠিকাদারকে হিসাব করে বিল প্রদান করা হবে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, নিজস্ব ড্রেজার না থাকায় পলিমাটি অপসারণের জন্য আপাতত বোমা মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের ড্রেজার কেনার প্রক্রিয়া চলমান। বাইশপুকুর এলাকায় ভাঙন রোধে ড্রেজিং করা মাটি তিস্তা নদীর ভাটিতে ভরাট করা হচ্ছে। ড্রেজার না আসা পর্যন্ত এই পদ্ধতি চালু রাখতে হচ্ছে।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রাসেল মিয়া বলেন, বিষয়টি দ্রুত খতিয়ে দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়াও পরিবেশ ও স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন