মেধাপাচারের থাবায় টালমাটাল উন্নয়ন
কোনো বিষয়ে সম্যকভাবে বোঝার, শেখার এবং সেই বিষয়ে স্বাধীন ও সৃজনশীলভাবে চিন্তা করার বিশেষ ক্ষমতার নাম হলো মেধা। কোনো ব্যক্তির মধ্যে যখন এরূপ গুণাবলীর সমন্বয় ঘটে তখন তিনি মেধাবী বলে অভিহিত হন। মেধা বলতে মূলত বোঝানো হয় একজন ব্যক্তি যে কি না যেকোনো একটি বিষয়ে দক্ষ কিংবা অভিজ্ঞ। মেধা পাচার বলতে সাধারণত বুঝায় কোন দেশের মেধাবী শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং দক্ষ জনশক্তির নিজ দেশ ত্যাগ করে বিদেশকে কর্মক্ষেত্র হিসেবে স্থায়ীভাবে বেছে নেয়া।
এই মেধা পাচার ঘটে সাধারণত অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ থেকে। কম বেশি সকল দেশেই এই সমস্যা আজ প্রকট।মেধা পাচার একটি আন্তর্জাতিক ঘটনা যা মানুষের অভিবাসন প্রক্রিয়ার একটি অনুষঙ্গ। কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন কিংবা শিক্ষিত মেধাবীদের বিরাট অংশের অভিবাসন অথবা অন্যদেশে গমনের ফলশ্রুতিতে মেধাপাচার ঘটে। সাধারণত যুদ্ধ, সুযোগ সুবিধার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা জীবন যাপনের ঝুঁকি এড়াতে মেধা পাচার ঘটে থাকে। তরুণ প্রজন্ম একটা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ।
তরুণ প্রজন্মের সঠিক পরিচর্যা ও তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ ও মূল্যায়নের ওপরই নির্ভর করে একটা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কেমন হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে তরুণ প্রজন্ম, মেধাবী প্রজন্ম ওভাবে পরিচর্যা পায় না, পায় না তার কাক্সিক্ষত মূল্যায়ন। এখানে মেধাবী হয়েও একজন তরুণ তাঁর মেধার মূল্যায়ন পান না। অথচ তাঁর চেয়ে কম যোগ্যতার কেউ একজন রাজনৈতিক চেষ্টা-তদবির বা ঘুসবাণিজ্যের মাধ্যমে তাঁর কাক্সিক্ষত যোগ্য আসনটি দখল করে নিচ্ছেন।
এমন ঘটনা তখন স্বাভাবিকভাবেই একজন মেধাবীর পক্ষে মেনে নেওয়ার কথা নয়।বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছরই অসংখ্য শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই পড়াশোনা শেষ করে সেখানে চাকরিতে ঢুকে পরবর্তী সময়ে সেখানকার স্থায়ী নাগরিক হয়ে যান। এভাবে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী হারাচ্ছে।
একজন মেধাবী দেশে যখন তাঁর যোগ্যতা অনুসারে চাকরি না পান, তখন তিনি হতাশ হবেন এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে নিরাপদ, সচ্ছল জীবনযাপনের জন্য তিনি যদি বিদেশে যান, তবে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। কাজেই বিদেশে মেধা পাচার রোধে দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়নে এখনই সচেতন হতে হবে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে তাঁদের নিয়োজিত করতে হবে দেশের কল্যাণে।
বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমানোর অন্যতম কারণ হচ্ছে দেশে মেধার যথাযথ মূল্যায়নের অভাব। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় মূল্যায়নের প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে মেধা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টা। বাংলাদেশে মেধার চেয়ে দলীয় আনুগত্য, চাটুকারিতা, কালো টাকা, পেশী শক্তির প্রভাব প্রভৃতির মূল্যায়ন অনেক বেশি। এই দেশে মেধাবীরা পদে পদে বিব্রত হয়। বাংলাদেশে একজন মেধাবী পেশাজীবীর চেয়ে স্বল্প মেধার চাটুকার টাইপ মানুষের মূল্য অনেক বেশি।
এই স্বল্প মেধার মানুষগুলো যখন শুধুমাত্র চাটুকারিতা উপজীব্য করে নীতিনির্ধারক পদে যায় তখন সেই মানুষগুলোর প্রণীত নীতির সাথে মানিয়ে চলা একজন মেধাবীর পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে তার দেশ ত্যাগ ছাড়া আর কোনো গতি থাকে না।মেধা পাচারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। আইনের শাসনের অভাব মেধাবীদের দেশের প্রতি বিমুখ করে তোলে। একজন মেধাবী ব্যক্তি যখন বুঝতে পারে যে তিনি তার প্রতি ঘটে যাওয়া কোনো অন্যায়ের বিচার পাবেন না। স্বভাবতই তিনি নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কা থেকে সেই দেশের প্রতি কোনো টান অনুভব করেন না। পাড়ি জমান নিরাপদ কোনো গন্তব্যে।
আরও পড়ুনবিশ্বায়নের যুগে তাল মেলাতে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই। তবে তাঁরা যদি দেশ থেকে হারিয়ে যান, এটা মেধা পাচার। দেশের মাটিতে বড়ো হয়ে, উচ্চশিক্ষা নিয়ে পরে শিক্ষকতাসহ প্রথম সারির বিভিন্ন পেশার কর্মক্ষেত্র ছেড়ে বিদেশে গমন। ভিন দেশের উন্নত গবেষণা ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আরো যোগ্য করেন। অনেকেই পারেন, কেউবা পারেন না। তবু যেন হাল ছাড়া নয়, থিতু হয়ে পড়ে থেকে সেসব দেশে স্থায়ী হয়ে যান। দেশকে নিয়ে ভাবেন, কেউ দেশের জন্যও কাজ করেন। উন্নত বিশ্বে শিক্ষা ও গবেষণায় রাজনীতির ভিন্ন ভিন্ন রং নেই।
জাতি তৈরির মহান পেশা শিক্ষক হতে হলুদ-বেগুনি, সাদা দল নয়, যোগ্যতা ও গবেষণার মানই মুখ্য। বিশ্ববিদ্যালয় আর বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষকেরা দিনরাত কাজ করেন আবিষ্কারের নেশায়। শিক্ষা ও গবেষণায় অর্জিত ফসল ছড়িয়ে যাচ্ছেন সবার কাছে। কৃষি, শিল্পকারখানায় সব জায়গায়। বিদেশের মাটিতে ওদের সঙ্গে মিশে প্রতিযোগিতায় আমরাও পারি। দেশেও সম্ভব। নিজ জায়গায় স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধের খুব দরকার। রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশের জন্য তুখোড় মেধাবীদের সুবিধা দিয়ে দেশের জন্য কাজে লাগাতে হবে।মেধা পাচার রোধে সর্বাগ্রে চাই মেধার মূল্যায়ন। সবকিছুর উপরে মেধার মূল্য দিতে হবে। শিক্ষা এবং গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থের বরাদ্দ দিতে হবে। শিক্ষাকে আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ না করে শিক্ষার মানোন্নয়নে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। যত বেশি শিক্ষাব্যবস্থার মানের উন্নয়ন ঘটবে দেশে ততবেশি মেধার প্রসার ঘটবে।
সব মিলিয়ে মেধা পাচারের মাত্রাটা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। এভাবে চলতে থাকলে দেশ অচিরেই মেধাশূন্য হয়ে উঠবে। এখনই এর লাগাম টেনে ধরতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।একজন মেধাবীর একমাত্র পরিচয় হবে তিনি মেধাবী। তিনি একমাত্র মেধার ভিত্তিতে মুল্যায়িত হবেন অন্য কোন ভিত্তিতে নয়। সমাজে যতদিন এই সত্য প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন মেধা পাচার রোধ সম্ভব নয়।
সুষ্মিতা ভট্টাচার্য্য মৌ
লেখক : নৃবিজ্ঞান বিভাগ
শাবিপ্রবি শাখার বর্তমান সভাপতি
মন্তব্য করুন