উন্নয়ন প্রকল্পের অধিকাংশ এখন সাদা হাতি
রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয় নাগরিকদের দুর্ভোগ লাঘব করে সুবিধা প্রদানের জন্য এবং রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে চাঙা করতে। কিন্তু এই মেগা প্রকল্পের নামে যদি চলে সীমাহীন দুর্নীতি অনিয়ম এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব থাকলে তা হয় সাদা হাতি। রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে কতটা দূরদর্শী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং স্বচ্ছতার সাথে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হবে– তার উপর।
সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সীমাহীন দুর্নীতির ফলে পতিত স্বৈরাচার সরকারের শাসন আমলে বাস্তবায়িত অধিকাংশ প্রকল্প এখন কাঁধে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে হাসিনা সরকারের স্বপ্ন দেখানো কয়েকটি মেগাপ্রকল্প উন্নয়নের সাদা হাতি হিসেবে অভিহিত হয়েছে। পদ্মা রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পায়রা বন্দর প্রকল্পে খরচ করা হচ্ছে এক লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। অথচ এখন পর্যন্ত এসব মেগাপ্রকল্পের অর্থনৈতিক আউটপুট শূন্য।
ঢাকা-ভাঙ্গা রেলের নেই চাহিদা, লক্ষ্যমাত্রার পাঁচ ভাগের এক ভাগ গাড়ি চলে কর্ণফুলী টানেলে। জ্বালানি সংকটে চালুর পর বারবার বন্ধ হয় মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। উদ্দেশ্য সফল হয়নি দোহাজারী- কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইন নির্মাণের। ফলে প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন করা জনগণের করের টাকা পুরোটাই জলে গেছে। প্রকল্পগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়নি। গল্প বলা হয়েছিল অতিরঞ্জিত করে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সীমাহীন দুর্নীতিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয়ের ফলে জনগণের উপর করের বোঝা বৃদ্ধি পেয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে জনগণের জীবনযাপনে।
পদ্মা রেললাইন প্রকল্প : সড়ক যোগাযোগে পদ্মা সেতু সফল হলেও পদ্মা রেল সেতুর ৩৯ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ পুরোটাই জলে গেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী, সহজলভ্য বাস, ভাড়া অপেক্ষাকৃত বেশি, সময়মতো ট্রেন না ছাড়াসহ কয়েকটি কারণে ট্রেনের চেয়ে বাসকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে ফরিদপুর ও ভাঙ্গার মানুষ।
ফলে ওই পথে লোকসান গুনছে রেলওয়ে। নতুন এই রেলপথে দৈনিক ২৪ জোড়া বা ৪৮টি যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করার কথা থাকলেও চলছে মাত্র ১০টি যাত্রীবাহী ট্রেন। মালবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি। ফলে এত বড় বিনিয়োগ করেও অর্থনীতিতে তার কোনো ভূমিকা নেই।
কর্ণফুলী টানেল : প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত কর্ণফুলী টানেল এখন ঘাড়ের ওপর বোঝা হয়ে উঠেছে। সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী, বেশির ভাগ সময় টানেল থাকে ফাঁকা। নেই যানবাহনের চাপ। নির্মাণের আগে জরিপে ২০ হাজারের বেশি গাড়ি চলবে বলা হলেও এখন গড়ে দৈনিক সাড়ে চার হাজার গাড়ি চলছে। দিনে গড়ে আয় হচ্ছে ১২ লাখ টাকার মতো। অথচ দিনে রক্ষণাবেক্ষণের খরচ সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। এর বাইরে চীনের ঋণ পরিশোধের দায় তো রয়েছেই।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প : বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের জন্য ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয়েছে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প। সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী, এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কয়লা আমদানির অনিশ্চয়তায় উৎপাদন বন্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুই ইউনিটের একটি পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনে ও আরেকটি পরীক্ষামূলক উৎপাদনে রয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বললেও এখনো এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করতে পারেনি। গড়ে এর উৎপাদন ৯০০ মেগাওয়াট। প্রকল্প পরিচালকের দুর্নীতিতে অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে কয়লা আমদানি। আগস্টের পর আর কয়লা আমদানি হয়নি। তিন বছরের কয়লা সরবরাহের জন্য কোল পাওয়ার জেনারেশন কম্পানি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে।
তবে প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ মেঘনা গ্রুপের ইউনিক সিমেন্ট কনসোর্টিয়ামকে সুবিধা দিতে ১০ মাস দেরি করেন। শেষ পর্যন্ত অনিয়মের অভিযোগ তুলে হাইকোর্ট কয়লা আমদানিতে ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা দেন গত জুলাই মাসে। যদিও সরকারের হস্তক্ষেপে পরে তুলে নেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা। সম্প্রতি মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিদর্শন করে একে 'প্রকল্প বিলাস' বলে অভিহিত করেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির।
আরও পড়ুনদোহাজারী-ঘুমধুম রেলপথ : ট্রান্স এশিয়ান রেল যোগাযোগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চট্টগ্রামের দোহাজারী ঘুমঘুম রেলপথ। সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে নতুন এই রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে।
তবে ১০ মাস ধরে ট্রেন চলাচল করলেও প্রত্যাশিত সংখ্যায় যাত্রী না পাওয়ায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী দৈনিক ২৬টি ট্রেনের পরিবর্তে বর্তমানে মাত্র ছয়টি ট্রেন চলাচল করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ট্রান্স এশিয়ান রেল যোগাযোগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি নেওয়া হলেও এর উদ্দেশ্য ছিল অবাস্তব। মায়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তের অংশের পুরোটাই পাহাড়ে ঘেরা। এই পাহাড় ভেদ করে মিয়ানমারের মূল অংশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ অবাস্তব স্বপ্ন।
গুণীজনদের অনেকে মনে করে, অধিকাংশ প্রকল্পই নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এর মাধ্যমে জনগণের কতটা লাভ হবে বা অর্থনৈতিকভাবে এই প্রকল্প গুলো থেকে কতটা সফলতা আসবে তা চিন্তা করা হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারসহ পরবর্তীতে যারাই দেশ পরিচালনা করবেন; তারা যেন প্রকল্পের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে প্রকল্প হাতে নেয় এবং সঠিক ফিজিবিলিটি স্টাডি করে। যাতে ভবিষ্যৎ প্রকল্প রাষ্ট্রের জন্য সাদা হাতি না হয়।
মাহমুদুল হাসান
লেখক : শিক্ষার্থী, আল ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
sumonbg2002@gmail.com
01303-275754
মন্তব্য করুন