বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর ও ভয়ংকর শাসক ইদি আমিন!
বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর এবং ভয়ংকর শাসকের নাম কেউ জানতে চাইলে সবার আগেই মাথায় আসবে হিটলারের কথা। তার সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্ব। তবে জানেন কি, হিটলার নয় তার চেয়েও ভয়ংকর একজন শাসক ছিলেন।
উগান্ডার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন, যার নৃশংসতা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। একসময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি নিজের নিষ্ঠুরতার নজির স্থাপন করেন। বিদ্রোহীদের ভয় দেখাতে জীবিত মানুষকে মাটিতে পুঁতে ফেলা কিংবা লাশ টুকরো করে কুমিরকে খাওয়ানোর মতো কাজ ছিল তার পরিচিতি।
ইদি আমিন দাদা উগান্ডার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ও বিতর্কিত শাসকদের একজন। তার শাসনামলে (১৯৭১-১৯৭৯) উগান্ডা এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে। তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করেন। তার শাসনের সময় গণহত্যা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, জাতিগত নিধন ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছিল।
ইদি আমিনের জন্ম ১৯২৫ সালে উগান্ডার ককোবা এলাকায়। তার পরিবার কাকোয়া জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার শৈশবেই উপজাতীয় রীতির প্রভাব তাকে নিষ্ঠুর করে তোলে। একসময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি নিজের নিষ্ঠুরতার নজির স্থাপন করেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং সেনাবাহিনীতে দ্রুত উন্নতি করেন।
ইদি আমিন তার শাসন কালে অসংখ্য এশীয় ও স্থানীয় উপজাতিদের ওপর অত্যাচার চালান। সন্দেহভাজন বিরোধীদের ধরে এনে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নির্যাতন করা হত। কক্ষগুলোতে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার বা ইলেকট্রিক শক দেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর পদ্ধতিতে মানুষ হত্যা ছিল নিয়মিত ঘটনা। তবে যা সবচেয়ে বিভীষিকাময় তা হলো, শত্রুদের মাংস খাওয়া। সমালোচকরা তাকে ‘উগান্ডার কসাই’ বলে ডাকতেন। লাশের সঙ্গে কথা বলা বা তাদের পাশে ঘুমিয়ে পড়া ছিল তার অমানবিক আচরণের অংশ।
১৯৬২ সালে উগান্ডা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং প্রধানমন্ত্রী মিলটন ওবোতে দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ইদি আমিন তখন উগান্ডার সেনাপ্রধান ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ওবোতেকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন।
ইদি আমিনের শাসনামল ছিল রক্তাক্ত, স্বৈরাচারী ও চরম নিপীড়নের। ইদি আমিনের নির্দেশে প্রায় ৩ থেকে ৫ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল। তিনি সামরিক বাহিনীর সাহায্যে বিরোধীদের নির্মূল করেন। বিচার ছাড়াই হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, অনেককে গুম করা হয়, এবং নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
দেশ থেকে এশিয় ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রায় ৬০ হাজার মানুষকে বের করে দেন। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে উগান্ডার জনগণের মধ্যে বিতরণ করেন, যা দেশের অর্থনৈতিক পতনের অন্যতম কারণ হয়। তবে এই ভারতীয় ও এশিয় বংশোদ্ভূতরাই ছিল উগান্ডার অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। তাদের বিতাড়িত করার ফলে উগান্ডার অর্থনীতি দ্রুত ভেঙে পড়ে, মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়, খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়, এবং কালোবাজারি ছড়িয়ে পড়ে।
ইদি আমিন ১৯৭৬ সালে আলোচিত এনটেবে বিমান ছিনতাই ঘটনায় জড়িত ছিলেন। প্যালেস্টিনিয়ান সন্ত্রাসীরা একটি ইসরায়েলি বিমান ছিনতাই করে এনটেবে বিমানবন্দরে নিয়ে গেলে তিনি তাদের সহায়তা করেন। ইসরায়েলি বাহিনী একটি সাহসী অভিযানের মাধ্যমে জিম্মিদের মুক্ত করে।
১৯৭৮ সালে ইদি আমিন প্রতিবেশী দেশ তানজানিয়ার ওপর আক্রমণ চালান। কিন্তু তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নিজেরেরি প্রতিরোধ গড়ে তুলেন এবং উগান্ডার বিদ্রোহীদের সহায়তা করেন। ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে তানজানিয়ার বাহিনী কাম্পালা দখল করে এবং ইদি আমিন সৌদি আরবে পালিয়ে যান। তিনি সৌদি আরবে নির্বাসিত জীবন কাটান এবং ২০০৩ সালে সৌদি আরবের জেদ্দায় মৃত্যুবরণ করেন।
ইদি আমিন নিজেকে বিভিন্ন আজব উপাধি দেন, যেমন- ‘হিজ এক্সিলেন্সি, প্রেসিডেন্ড ফর লাইফ, ফিল্ড মার্সাল আল হাজি ডক্টর ইদি আমিন দাদা, ভিসি,ডিএসও,এমসি, লর্ড অব অল দ্য বেস্টেস অব দ্য আর্থ অ্যান্ড ফিসেস অফ দ্য সি, অ্যান্ড কনকুয়েরেটর অব দ্য ব্রিটিশ ইম্পাইয়ার ইন আফ্রিকা ইন জেনারেল অ্যান্ড উগান্ডা ইন পার্টিকুলার’। এছাড়া তিনি আরও দাবি করতেন, তিনি স্কটল্যান্ডের রাজা!
সূত্র: নইসার, ব্রিটানিকা
মন্তব্য করুন