অদম্য ইচ্ছেশক্তির জোরেই অন্ধত্বকে জয় করে শিক্ষকতা করছেন বিলকিস

সাহাদত জামান সারিয়াকান্দি (বগুড়া) থেকে ঃ নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মেনেছে বগুড়ার সারিয়াকান্দির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বিলকিসের অন্ধত্ব। অন্ধ হয়েও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে তিনি সরকারি চাকরি পেয়েছেন। ব্রেইলী পদ্ধতিতে তিনি শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছেন।
অন্ধ এ শিক্ষকের শেখানো পাড়াগুলো হুবহু পাঠ্য বইয়ের সাথে মিলে যাচ্ছে। উপজেলার কর্ণিবাড়ী ইউনিয়নের দেবডাঙ্গা কালিবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ৫ম শ্রেণির ইসলাম শিক্ষা ক্লাস নিচ্ছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিলকিস খাতুন। বিলকিস খাতুন মুখ দিয়ে যা বলছেন তা শিক্ষার্থীরা একসাথে জোরে জোরে উচ্চারণ করছেন। বিলকিসের শেখানো পড়াগুলো পাঠ্য বইয়ের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য যে, বিলকিস খাতুনের বইয়ে কোনও অক্ষর নেই। একেবারেই পৃষ্ঠাগুলো সাদা। সেখানে সারা পৃষ্ঠাজুড়ে শুধুমাত্র কয়েকটি ডটডট। পরে বিলকিসের সাথে কথা বলে জানা গেল এই ডটগুলো হাতের সাহায্যে অনুভব করেই তিনি বুঝতে পারেন কোনটি কোন অক্ষর । বিলকিস উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের দেবডাঙ্গা গ্রামের মৃত গিয়াস মোল্লার মেয়ে। তিনি একজন জন্মগত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। বিলকিস জানান, ৫ বছর বয়সে যখন তিনি বুঝেন, তার প্রতিবেশি সব শিশুরাই স্কুলে আসা-যাওয়া করে, তখন তার খুবই খারাপ লাগতো। বিলকিছ তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে তারপরেও দু’একদিন স্কুলে যাতায়াত করেন। সেখানে শিক্ষকদের কথা শুনতে পারলেও ব্লাকবোর্ডের লেখা দেখতে পারতেন না। তারপর তার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। তার আপন বড়ভাইও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তিনি একটি মাধ্যমে অন্ধদের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরে বিলকিসকে রাজশাহী পিএইচটি সেন্টারে ভর্তি করান। এরপর তিনি জয়পুরহাটের খনজনপুর মিশন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এস এস সি পাশ করেন। পরে ঢাকার বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচ এস সি এবং ইডেন মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেন। পরে প্রাইমারিতে সরকারি চাকরির আবেদন করেন এবং প্রথম পরীক্ষাতেই তিনি প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারিতে সারিয়াকান্দি নিজ চন্দন বাইশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এরপর ২০২৩ সালের ৩০ মে স্থানান্তরের মাধ্যমে যোগদান করেন দেবডাঙ্গা কালীবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
৫ম শেণির একজন শিক্ষার্থী বলেন, ম্যাডাম আমাদের যে পড়া শেখান, তা আমাদের বইয়ের পড়ার সাথে হুবহু মিলে যায়। তার পড়া বুঝতে আমাদের কোনোও সমস্যা হয় না। স্বাভাবিকভাবেই তার পড়া বুঝা যায়। বিলকিসের সহকর্মী বলেন, কর্মস্থলে বিলকিস খুব আন্তরিকতার সাথে কাজ করেন এবং তিনি কখনো ক্লাস ও স্কুলে অনুপস্থিত থাকেন না। আমরা তাকে বেশ সহযোগিতা করছি। তিনি ব্রেইল পদ্ধতিতে ক্লাস পরিচালনা করেন। এতে শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হয় না। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইউনুস আলী বলেন, বিলকিস খাতুন তার অদম্য প্রতিভার পরিচয় দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় এসেছেন। আমি আন্তরিকতার সাথে তার পাঠদানের কৌশলগুলো পর্যবেক্ষণ করেছি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হলেও আমরা তাকে কখনও আমাদের চেয়ে আলাদা মনে করি না। আমরা তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করি, যদিও তিনি নিজের কাজগুলো নিজেই করে থাকেন। তিনি শিক্ষার্থীদের ইসলাম শিক্ষা এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ে পাঠদান করান। একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে তিনি সকল আলাদা ধরনের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন।
সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার রহমান বলেন, বিলকিস খাতুন সকলের জন্য একটি উদাহরণ। একজন প্রতিবন্ধী হয়েও সমাজের জন্য তিনি বোঝা হয়ে না থেকে তার ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে তিনি সম্পদে পরিণত হয়েছেন। তার সফলতার গল্প শুনে অন্য প্রতিবন্ধীরাও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য চেষ্টা করবে। তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হবে।
আরও পড়ুন
মন্তব্য করুন