কোরআন সুন্নাহর আলোকে মাতৃভাষার তাৎপর্যতা

ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের ভাষার মাস। ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই মনে করিয়ে দেয় বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। ভাষা আল্লাহপাকের অন্যতম নিয়ামত ।মানুষই একমাত্র বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে পারে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বর্ণের বিভিন্ন গোত্রের মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে কিন্তু প্রাণীগুলো সব একই ভাষায় কথা বলে গরু ছাগল যে দেশেই থাক না কেন তাদের ভাষা একই শুধুমাত্র মানুষের বেলায় ব্যতিক্রম।
পবিত্র কোরআনুল কারিমে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর তার নির্দেশনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য।’ (সুরা রুম, আয়াত : ২২,।) মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি-এ তিনটি শব্দ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে পরম মমতা ও আবেগের। মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষা। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনি তাকে শিখিয়েছেন ভাব (ভাষার মাধ্যমে)প্রকাশ করতে।’ (সুরা আর রহমান, আয়াত : ০৩-০৪, পারা : ২৭)।
মানুষের মুক্তির পয়গাম নিয়ে পরিপূর্ণ জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে সব ধরনের সমস্যার কঠিন ও নির্ভুল সমাধানের নিমিত্তে যুগে যুগে মহান আল্লাহতায়ালা যত নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন, সবাইকে স্বজাতীয় ভাষায় কিতাব প্রেরণ করেছেন এবং সব আসমানি কিতাবকে তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় অবতীর্ণ করেছেন। যেমন : মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৪, পারা : ১৪)।
আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিম মাতৃভাষায় অবতীর্ণ না করতেন তাহলে আরবের মূর্খ পন্ডিতরা কী করত এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি যদি আজমি ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ করতাম, তবে তারা অবশ্যই বলত এর আয়াতগুলো বিশদভাবে বিবৃত হয়নি কেন? কী আশ্চর্য যে, কোরআন আজমি অথচ রাসুল আরবি।’ (সুরা হা-মিম সেজদা, আয়াত : ৪৪, পারা : ২৪)। এ ছাড়া সুন্দর ও বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা উন্নত ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। ধর্ম প্রচারে শুদ্ধ ভাষা ও সুন্দর বর্ণনার প্রভাব অতুলনীয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আনা আফসাহুল আরব, অর্থাৎ- আমি আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী।’ (মিশকাত শরিফ)। এ কারণেই বহু ভাষাবিদ পন্ডিত ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন আমাদের মা তিনটি "একটি গর্ভধারিনী মা একটি মাতৃভাষা মা এবং মাতৃভূমি মা"। যারা এই তিন মাকে ভালবাসবে শ্রদ্ধা করবে তারাই হবে দুনিয়া এবং আখেরাতে কামিয়াবী।
তাই বিশুদ্ধভাবে মাতৃভাষায় কথা বলা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত। মাতৃভাষাপ্রীতি সঞ্চারিত হয় ইসলামে মাতৃভাষার ওপর অত্যধিক গুরুত্বারোপের কারণে। সুতরাং নিজ মাতৃভাষা বাংলা ভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করা আমাদের ওপর অপরিহার্য। নবী (সা.)-এর কাজের দায়িত্ব যেহেতু আমাদের ওপর অর্পিত হয়েছে, তাই নিজ মাতৃভাষায় অভিজ্ঞতা অর্জন করে মানুষের সামনে ইসলামের সঠিক মর্মবাণী বিশুদ্ধভাবে সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় লেখা ও বলার মাধ্যমে উপস্থাপন করা আমাদের ওপর অবশ্যই কর্তব্য।
আমরা যদি আমাদের দায়িত্বে অবহেলা করি, তাহলে দেশবাসীর প্রতি অবিচার করা হবে এবং মহান প্রভুর কাছে পরকালে পাকড়াও হতে হবে। সাহিত্যিক সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বাংলাদেশ সফরে এসে বলেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নিতে হবে এবং অপশক্তির হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হবে।
এ ব্যাপারে অনেকের প্রশ্ন, আমাদের এই মাতৃভাষা তো আমাদের মুসলমানদের ভাষা নয়। এজন্যই অনেকে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে গুরুত্ব দেয় না। অথচ বাস্তব বিষয়টি অনেকেরই অজানা। কোনো কোনো ভাই মনে করেন, এই ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন করলে মানুষ নাস্তিক হয়। এই ভাষায় কোনো নুর নেই। উত্তরে বলতে হয়, আরবি ভাষা তো ছিল আবু জাহেল, উতবা ও শায়বাদের।
ফারসি ভাষা ছিল অগ্নিপূজকদের। তাই বলে কি সে দেশের মুসলমানরা তাদের মাতৃভাষা আরবি-ফারসি বর্জন করেছেন? না, করেননি। বরং তারা ইসলামি জ্ঞান দ্বারা সে ভাষার সাহিত্য আরো সমৃদ্ধ করেছেন। ফলে সে ভাষায় নুর এসেছে এবং পরিণত ভাষায় পরিণত হয়েছে মনে রাখতে হবে বাংলা ভাষা কোনো একক ধর্মীয় গোষ্ঠীর পৈতৃক সম্পত্তি নয়,। বাংলা ভাষা মুসলিম শাসকদের দ্বারাই সমৃদ্ধ লাভ করেছে। বিশেষ করে সুলতান ইলিয়াস শাহর শাসনকালে। এজন্য তাকে বঙ্গীয় উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল।
আরও পড়ুনতার কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ। বাংলা সনের জন্ম হয় সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে। হিজরি সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৎকালীন মহাপন্ডিত ‘আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজী’ বাংলা সনের উদ্বোধন করেন। পক্ষান্তরে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল একটি পক্ষ। যারা বাংলা ভাষায় কথা বলত তাদের শাস্তি দেওয়া হতো। জনগণকে ভীতি প্রদর্শন করত যে, ‘ভাষাং মানবঃ স্রোতা বৌরবং নরকং ব্রজ্রে’ অর্থাৎ-সংস্কৃতি ভাষা ছাড়া যারা অন্য ভাষা তথা বাংলা ভাষায় কথা বলবে তাদের বৌরব নামক নরকে নিক্ষেপ করা হবে।
ড. দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন, ইতরের ভাষা বলে বাংলা ভাষাকে পন্ডিতরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতেন। প্রকৃত অর্থে এই জনপদে বসবাসরত প্রত্যেক মানব সন্তানই এর উত্তরাধিকারী। বাংলা ভাষা এই পাললিক ভূমির আপামর জনতার ভাষা। আমাদের মাতৃভাষা। মনে রাখতে হবে আমাদের মায়ের ভাষা কেড়ে নেয়ার জন্য পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী অনেক নিপীড়ন নির্যাতন করেছে। একমাত্র বাঙালিদেরকেই মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য আন্দোলন ও সংগ্রাম করতে হয়েছিল।
যার কারণে আজ বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস হিসাবে পুরো পৃথিবীতেই উদযাপিত হচ্ছে যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও গৌরবের বিষয়। এমনকি আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানেও আজকে আমাদের মাতৃভাষা দিবস পালন করতে হচ্ছে। ১৯৫২ সালে যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এবং মাগফেরাত কামনা করছি। বিশেষ করে রফিক সালাম বরকত জব্বার সহ অনেকেই। আরো স্মরণ করছি বগুড়ার সেই ভাষা সৈনিক গাজী রহমান সহ যারা ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।
আরবি ফারসি উর্দু থেকে ইসলামী চিন্তা চেতনা দর্শনের উপর লিখিত বইগুলো বাংলায় অনুবাদ হচ্ছে। ফলে ইসলামী শরীয়তের মাসলা মাসায়েলগুলো বাংলাভাষীদের জন্য সহজেই বোধগম্য হচ্ছে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এই ভাষাতেই আমরা আমাদের গবেষণা আমাদের চিন্তা চেতনার উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
মোহাম্মদ মোস্তাকিম হোসাইন
লেখক : ইসলামি কথা সাহিত্যিক, গবেষক ও কলামিস্ট
মন্তব্য করুন