ভিডিও বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫

-রুশো আরভি নয়ন 

বর্ণমালার প্রথম বিদ্রোহ

বর্ণমালার প্রথম বিদ্রোহ

আমার দাদু ছিলেন পুরোনো দিনের মানুষ, গম্ভীর এবং একটু রাগী স্বভাবের। তার কণ্ঠস্বর ছিল ভারী, যেন পুরোনো দিনের কোনো রেডিও। সন্ধ্যাবেলা বারান্দায় বসে লাল চা খেতে খেতে তিনি গল্প বলতেন। কখনো মুক্তিযুদ্ধ, কখনো তার শৈশব, আবার কখনো ভাষা আন্দোলনের সময়কার কথা।

আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম ভাষা আন্দোলনের গল্প। কেমন ছিল সেই দিনগুলো? কীভাবে এত মানুষ একসঙ্গে প্রতিবাদে দাঁড়িয়েছিল ভাষার জন্য? এক সন্ধ্যায়, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "দাদু, তুমি কি ভাষা আন্দোলনে ছিলে?" তিনি চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে একটু চুপ করলেন, তারপর বললেন, "তোর বাবার জন্মও হয়নি তখন। আমি কলেজে পড়তাম, আর ঢাকা তখন আগুনের মতো গরম। সবাই বুঝতে পারছিল, আমাদের ভাষাকে কেড়ে নিতে চাইছে কেউ।"

আমি অবাক হয়ে বললাম, "তোমরা তখন কি খুব ভয় পেয়েছিলে?" দাদু হেসে উঠলেন, কিন্তু সেই হাসিতে কোথাও একটা কষ্ট ছিল। "ভয়? ভয় তো ছিলই। কিন্তু তার থেকেও বড় ছিল রাগ। নিজের ভাষাকে রক্ষা করতে না পারলে আমরা কেমন মানুষ হব? তখনো বুঝতাম না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে অনুভব করতাম এ লড়াই শুধু ভাষার জন্য নয়, এ লড়াই আমাদের আত্মপরিচয়ের জন্য।" আমি অধীর হয়ে বসে আছি, আর তিনি স্মৃতির দরজা খুলে ফেলেছেন।

বলতে শুরু করলেন "আমি তখন ষোলো বছরের একটা ছেলে। ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের নিয়ে পোস্টার লিখতাম, লিফলেট বানাতাম, দেয়ালে স্লোগান লিখতাম। একদিন শুনলাম, বড়রা মিছিল করবে। ভাবলাম, আমরাও যাব। কিন্তু জানতাম, বাবা জানলে মারধর করবেন। তাই চুপচাপ দুপুরে বেরিয়ে পড়লাম।" আমি অবাক হয়ে বললাম, "তুমি কি আগে কখনো মিছিলে যাওনি?"

আরও পড়ুন

দাদু মাথা নাড়লেন। "না, এর আগে শুধু পোস্টার টাঙিয়েছি। কিন্তু সেদিন, শহরের বাতাসেই যেন বিদ্রোহ ছিল। মনে হচ্ছিল, আমার হাত-পা কাঁপছে, কিন্তু বুকের ভেতর একটা আগুন জ্বলছে। আমাদের চারপাশে হাজারো মানুষ। মাথার ওপর পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে বন্দুক নিয়ে। সামনে থেকে বড় ভাইয়েরা চিৎকার করছিলেন 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!' আর আমরা সবাই একসঙ্গে গলা মেলাচ্ছিলাম।"আমি দাদুর দিকে তাকিয়ে রইলাম, যেন তার কথাগুলো আমাকে সেই সময়ে নিয়ে যাচ্ছে। "হঠাৎ করেই গুলির শব্দ! চারপাশে চিৎকার। আমি দেখি, সামনে এক বড় ভাই মাটিতে পড়ে গেলেন।

তার বুক থেকে রক্ত বেরোচ্ছে, লাল হয়ে যাচ্ছে সাদা পাঞ্জাবি। তারপর আরেকজন, আরেকজন আমরা ছুটতে শুরু করলাম, কিন্তু মনটা বলতে লাগল না, দৌড়াব না! এ তো আমার লড়াই!" আমি গিলে ফেললাম। আমার কল্পনায় তখন শহিদ মিনারের সামনে পড়ে থাকা রক্তমাখা শরীর। দাদু ধীরে ধীরে বললেন, "সেই রক্তের গন্ধটাই আমাকে বদলে দিয়েছিল। বাংলা ভাষা তখন আমার কাছে শুধু পড়ার বিষয় ছিল না, ওটা হয়ে উঠল আমার আত্মা।

"আমি গভীরভাবে শুনছিলাম, কিন্তু কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেক বছর পর, যখন ভাষা দিবসে আমি শহিদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আমার মনে পড়ল দাদুর সেই গল্প। তার কণ্ঠস্বর এখন আর শোনা যায় না, কিন্তু আমি অনুভব করলাম, আমার বুকের ভেতরেও সেই ষোলো বছরের ছেলেটার মতো কিছু একটা জেগে উঠছে। আমার দাদুর মতো হাজারো তরুণের বুকের ভেতরেই তো জন্ম হয়েছিল বর্ণমালার প্রথম বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহেই তো আজ আমরা স্বাধীন ভাষায় কথা বলছি।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রূপপুর প্রকল্পের প্রথম ইউনিটে সফলভাবে স্থাপিত হলো টারবাইন

গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত সরকার ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়- সাবেক এমপি কাজী রফিক

জামায়াতের পক্ষ থেকে অর্থ সহযোগিতা পাচ্ছেন নৌকাডুবিতে বাবা-মা হারানো ছোট্ট দিপু

বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলে গণহত্যা দিবস পালন

বগুড়ার ধুনটে ২ ফ্রিল্যান্সারকে অপহরণের পরিকল্পনাকারী পুলিশ গ্রেফতার

বগুড়ায় ঈদের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু : প্রথম দিন দীর্ঘ লাইন