আবহাওয়া অনুকূলে থাকার পরও প্রতিযোগিতায় উৎপাদন কমেছে
সচল হয়ে উঠেছে বগুড়ায় সেমাই পল্লীর চাকা

নাসিমা সুলতানা ছুটু : বগুড়া শহরের অদূরে কালসিমাটি গ্রামের পথ ধরে হেঁটে গেলেই রাস্তার পাশে জমির আইলে ও ফাঁকা মাঠে চোখে পড়বে সাদা চিকন সেমাই শুকানোর দৃশ্য। নারী-পুরুষ অতি যত্নে সেমাইগুলো উল্টে-পাল্টে শুকাচ্ছেন। সারা বছর এমন দৃশ্য চোখে না পড়লেও শব-ই বরাতের পর থেকে পুরো রমজান মাস জুড়েই এমন দৃশ্য চোখে পড়বে।
পবিত্র রমজান মাসে এবং ঈদে বগুড়ার চিকন সেমাইয়ের কদর দেশজুড়ে। তাই রমজান আসার আগেই সচল হয়ে উঠে সেমাই পল্লীর চাকা। ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় দম ফেলার সময় পাচ্ছেন না কারিগররা। শব-ই বরাতের পর থেকেই শুরু হয়েছে সেমাইয়ের উৎপাদন। প্রতিদিন সেহরির পর থেকেই কারখানাগুলোয় শুরু হয় সেমাই তৈরির কাজ। চলে আসর পর্যন্ত। এবার আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে, নেই শেডিং তবু উৎপাদন কম হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে বেকারি মালিকেরা এবার চিকন সেমাই উৎপাদন করছে।
শহরতলীর বেজোড়া, কালিসামাটি, শ্যাঁওলাগাতি ও শ্যামবাড়িয়া এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই সেমাই পল্লী। আগে অর্ধশত’র বেশি কারখানা থাকলেও এখন তা অনেক কমে গেছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব কারখানায় অন্তত দুই শতাধিক নারী শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের হাতের ছোঁয়ায় ময়দা থেকে উৎপাদিত চিকন সেমাইয়ের কদর বছরের পর বছর থেকে চলে আসছে। সারা বছর উৎপাদিত না হলেও রমজান এবং ঈদের মৌসুমে সেমাইয়ের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সেমাই দিয়ে তৈরি নানা ধরণের মিষ্টান্ন তৈরি হয় ধনী-দরিদ্র সবার বাড়িতেই। তবে কয়েক বছর আগেও যেখানে পল্লীর ঘরে ঘরে গড়ে ওঠা প্রতিটি কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ২৫০ কেজি অর্থাৎ ১০ খাঁচি করে সেমাই তৈরি হতো।
গত কয়েক বছর থেকে শহরের বেকারিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে উৎপাদন কমে এখন বড় কারখানাগুলোই দিনে ১শ’ থেকে ১৫০ কেজির বেশি অর্থাৎ দিনে ৪/৫ খাঁচির বেশি সেমাই তৈরি করতে পারে না। সেমাই কল মালিকরা করতোয়া’কে জানিয়েছেন, শ্রমিকদের মজুরী এবং বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এছাড়া বাজারে প্রতিযোগিতাও চলছে। আগে শুধু এই ক’টি গ্রামেই বগুড়ার বিখ্যাত এই চিকন সেমাই তৈরি হতো, কিন্তু এখন বিভিন্ন বেকারিতে চিকন সেমাই তৈরি করা হচ্ছে।
বেকারি মালিকরা সেমাই তৈরি এবং শুকানোর জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করায় তারা প্রতিযোগিতায় কিছুটা পিছিয়ে পরেছেন। প্রতিযোগিতামূলক বাজারের কারণে সেমাইয়ের দামও তেমন বাড়াতে পারেননি। প্রকার ভেদে প্রতি কেজি সেমাই তারা ৪৪ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করছেন। সেমাই কল মালিক ও কারিগরদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী এক বস্তা (৩৭ কেজি) ময়দা থেকে গড়ে ৩৫ কেজি চিকন সেমাই পাওয়া যায়। এক বস্তা ময়দা থেকে সেমাই তৈরি এবং তা রোদে শুকানোর বিনিময়ে প্রত্যেক কারিগরকে এবার ২৫০ থেকে ৩শ’ টাকা মজুরি দেওয়া হচ্ছে।
এক বছর আগে এই মজুরী ছিল ১৮০ থেকে ২২০ টাকা। বেজোড়া গ্রামের সেমাই উৎপাদনকারী জাহাঙ্গীর আলম করতোয়া’কে জানিয়েছেন, সেমাই তৈরির জন্য তার আপাততঃ নিজের কল নেই। অন্যের দুটি কল ভাড়া নিয়ে সেমাই উৎপাদন করছেন। তার কারখানায় নিয়মিত কাজ করেন ৪ জন নারী শ্রমিক। উৎপাদন বেশি থাকলে তখন শ্রমিকের সংখ্যাও বাড়িয়ে দেন।
আরও পড়ুনদিনে ৫ থেকে ৬ বস্তা ময়দার প্রায় ১শ’ থেকে ১৫০ কেজি সেমাই তিনি উৎপাদন করেন। আগে আরও অনেক বেশি করতেন। এবার আবহাওয়া অনুকূলে এবং বিদ্যুতের লোডশেডিং না থাকলেও উৎপাদন কমে দেওয়ার কারণ জানাতে গিয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, আগে শুধু এই ক’টি গ্রামেই চিকন সেমাই তৈরি হতো। কিন্তু এখন শহরের ছোট-বড় সব ধরণের বেকারি সেমাই একই সেমাই তৈরি করছে। তারা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এজন্য প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারছি না।
বগুড়া আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল করতোয়া’কে জানান, গত কয়েক বছরের মত এবারও তারা চিকন সেমাই তৈরি করছেন। তাদের কারখানায় তৈরি সেমাই বিশেষ কায়দায় তৈরি বড় ওভেনে শুকানো হয়। এছাড়া কিছু কিছু সেমাই তারা ওভেনে ভেজেও বিক্রি করেন। তাদের বেকারিতে তৈরি সেমাই তারা পাইকারী ৮০ টাকা ও খুচরা ৯০ টাকা কেজি বিক্রি করেন।
আলাল জানান, আকবরিয়ার মত বগুড়ার এখন অনেক বেকারিই চিকন সেমাই তৈরি করছে। সেমাই পল্লীর সেমাই রোদে শুকানোর প্রক্রিয়া স্বাস্থ্যসম্মত নয় দাবি করেন। বেকারিতে সেমাই তৈরি করি তারা সবাই তন্দুরে অথবা ওভেনে সেমাই শুকাই। কিন্ত সেমাই পল্লীর সেমাইগুলো মাঠে, বাড়ির উঠানে বা রাস্তার ধারে খোলা জায়গায় শুকানো হয়। এই কারণে তাদের উৎপাদিত সেমাইয়ের চাহিদা শহরাঞ্চলে কিছুটা কমেছে।
বগুড়া শহরের রাজাবাজার এলাকায় সেমাইয়ের বাজার ঘুরে দেখা গেছে রমজানের শুরু থেকেই শুরু হয়েছে বেচা-কেনা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আসছেন। সেমাই পল্লীর সেমাইগুলো খোলা খাঁচিতে বিক্রি হলেও বিভিন্ন বেকারির সেমাই প্যাকেটজাত করে বিক্রি হচ্ছে। খোলা সেমাই খুচরা ৮০ টাকা কেজি আর প্যাকেটজাত সেমাইয়ের দাম কিছুটা বেশি পড়ছে বলে দোকানিরা জানান। ওই বাজারের মনোহারী দোকানী উজ্জ্বল জানান, রমজানের শুরু থেকে সেমাই কেনাবেচা হলেও ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে সেমাইয়ের বেচাকেনা ততই বাড়ছে।
মন্তব্য করুন