একাত্তরের পঁচিশ মার্চ
বগুড়ায় রাতভর প্রস্তুতি : প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে পাকিস্তানী বাহিনী

স্টাফ রিপোর্টার: ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বগুড়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। স্কুল-কলেজের ছাত্রদের সমন্বয়ে শহরের প্রতিটি মহল্লায় ‘স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগেড’ গঠন করা হয়। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য স্থানীয় জিলা স্কুলে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করা হয়। সেখানে স্কুলের ক্যাডেটদের কাঠের রাইফেল ব্যবহার করে দিনভর পর্যায়ক্রমে ব্রিগেডের ৫০০ সদস্যকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি অফিসারদের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ চলতো। এর পাশাপাশি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ব্রিগেডের সদস্যরা স্কুলের ড্রাম নিয়ে প্রতিদিন বিকেলে শহরে রোড মার্চ করতেন।
স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগেড গঠন সম্পর্কে প্রয়াত ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা এড. আব্দুর রাজ্জাক তার জীবদ্দশায় যে বর্ণনা দিয়েছিলেন তা হলো- ‘৭ মার্চের ভাষণের আগেই তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মস্কোপন্থি) একটি গোপন সার্কুলার বাহক মারফত বগুড়া জেলা পার্টি নেতৃবৃন্দের কাছে আসে। সেই সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) অভ্যন্তরে কর্মরত পার্টি কমরেড যথাক্রমে মাহফুজার রহমান মান্না, আব্দুর রাজ্জাক, এস এম রফিকুল ইসলাম লাল, নুরুল আনোয়ার বাদশা, দৌলতুজ্জামান, তরিকুল আলম ধলু এবং মঞ্জুরুল হক খান মঞ্জুকে নিয়ে পার্টির নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসেন। উল্লেখিত সার্কুলারে বলা ছিল দেশ সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কাজেই অতি দ্রুত ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের নিয়ে ডেমি রাইফেলের মাধ্যমে ট্রেনিং শুরু করতে হবে এবং জনগণের দৃষ্টি যাতে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে অগ্রসর হয় সে ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে। ওই সভায় ছাত্র ইউনিয়নের নব নির্বাচিত জেলা সভাপতি মাহফুজার রহমান মান্নাকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা হয়। কমান্ড কাউন্সিলের অপর চারজন সদস্য যথাক্রমে এস এম রফিকুল ইসলাম লাল, আব্দুর রাজ্জাক, নুরুল আনোয়ার বাদশা এবং বদিউল আলম পলক। আরও সিদ্ধান্ত হয় মাছুদার রহমান হেলালকে কমান্ডার এবং মোজাম্মেল হক লালুকে সহকারী কমান্ডার করে প্রতিদিনের ট্রেনিং কার্যক্রম পরিচালিত হবে। তারপর থেকেই ব্রিগেড গঠনের কাজ চলতে থাকে’। ২৫ মার্চ সেই রাতে প্রতিটি পাড়া-মহলায় ঢাক-ঢোল এমনকি থালা-বাটি বাজিয়েও মানুষকে জাগিয়ে তোলা হয়। শ্লোগান ওঠে ‘পুলিশ জনতা ভাই ভাই বাংলাদেশ স্বাধীন চাই’।
স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগেডের কর্মীরা পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য বাড়ি বাড়ি থেকে লাইসেন্স করা এক নলা বন্দুক সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেকে এয়ারগান নিয়েও বেড়িয়ে পড়েন। ছাত্র-যুবকরা শহরের ঝাউতলা এলাকার দুটি বন্দুকের দোকানের তালা ভেঙ্গে একনলা বন্দুক ও পিস্তল সংগ্রহ করেন। আর রাত জাগা শত শত মানুষ শহরের উত্তর দিকে রংপুর রোডে বেরিকেড সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন মোড়ে গাছের ডাল ও বাঁশ কেটে ফেলতে শুরু করে। অনেক এলাকায় রাস্তার পাশের টিনের দোকান ঘরও উল্টিয়ে রাখা হয়। এরপর প্রতিরোধের জন্য পজিশন নেওয়ার পালা। থানার সামনের এক নম্বর, দুই নম্বর ও তিন নম্বর রেল গেট থেকে দক্ষিণে সাতমাথা পর্যন্ত সড়কের পাশের বাড়ি-ঘরে এবং ভবনের ছাদে অস্ত্র হাতে পুলিশ সদস্যরা পজিশন নেয়। তাদের অস্ত্র আসে পুলিশ লাইনের অস্ত্র ভান্ডার থেকে। আর তরুণ যোদ্ধারা ৩টি রেলগেটের সামনে থেকে উত্তরে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে শহরের কালিতলা হাট পর্যন্ত বিভিন্ন মোড়ে অবস্থান নেয়। পাক বাহিনীর কোন ভারি যান যেন মূল শহরে ঢুকতে না পারে সে জন্য শেষ প্রতিরোধ হিসেবে (লাস্ট বেরিকেড) রেল স্টেশন থেকে মালবাহী ট্রেনের কয়েকটি বগি ঠেলে ২নং রেলগেট (লেভেল ক্রসিং) বরাবর রাখা হয়। তারপর সবগুলো গেট বন্ধ করে তালা দিয়ে চাবিও তারা নিয়ে নেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মাছুদার রহমান হেলালের ভাষ্যমতে, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী শহরের কালিতলা এলাকায় অবস্থান নেন এনামূল হক তপন ও বুলবুলসহ (পরে শহীদ হন) কয়েকজন যুবক। তাদের পেছনে দত্তবাড়ি এলাকায় পজিশন নিই আমি মাছুদার রহমান হেলাল, ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান রতন, শোকরানা ও তার সহযোগীরা। তারও পরে বড়গোলা এলাকায় বিভক্ত হয়ে যাওয়া ৩টি সড়ক লাগোয়া তৎকালীণ ইস্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাংকের (বর্তমানে পূবালী ব্যাংক) ছাদের ওপর বন্দুক হাতে পজিশন নেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা টি. এম মুছা পেস্তা তার ছোট ভাই একই সংগঠনের স্কুল শাখার সভাপতি টি. এম আইয়ুব টিটু, হামিদ, ছোট তারেক (পরে শহীদ হন) ও বেলাল।তাদের সহযোগী হিসেবে মাঝখানে ইউনাইটেড ব্যাংক (বর্তমানে জনতা ব্যাংক) ভবনের ওপর অবস্থান নেন মোস্তাফিজুর রহমান হুনু, হিটলু, দোলন ও শাফি। তাদের সবার হাতে ছিল বন্দুক।
হাত বোমা নিয়ে পূর্ব দিকে রাজাবাজারমুখি সড়ক সংলগ্ন ক্যালকাটা বেকারির ওপরে প্রস্তুত ছিলেন শরীফ ও লুলু। আর ২নং রেলগেটের আগে ঝাউতলা এলাকায় বোম্বে সাইকেল স্টোর নামে একটি প্রতিষ্ঠানের টিনের চালের ওপর ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী আনোয়ারুল হক আজাদ। ভোর ৬টা নাগাদ পাকিস্তান সেনারা শহর থকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে গোকুল এলাকায় এসে তোতা মিয়া নামে এক পথচারীকে প্রথমে গুলি করে হত্যা করে। গাছের ডাল-পালা ফেলে সড়কে বেরিকেড সৃষ্টি করায় সেগুলো সরিয়ে কালিতলা হাট পর্যন্ত সাড়ে ৫ কিলোমিটার আসতে তাদের এক ঘন্টা লেগে যায়। সেখানে পৌছার পর পরই রফিক নামে স্থানীয় এক যুবক মসজিদের সাইরেন বাজিয়ে এলাকাবাসীকে সতর্ক করেন। সেখানে এনামুল হক তপনসহ একদল যুবক পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। সেখানে অজ্ঞাতনামা নামে এক রিকশা চালক নিহত হয়। এরপর পাকিস্তানী সেনারা শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের বহর দত্তবাড়ি এলাকায় পৌঁছার পর পরই প্রতিরোধকারী ছাত্র-যুবকদের বন্দুক গর্জে ওঠে। বড়গোলা এলাকায় পৌঁছার পর পরই তরুণ যোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাদের ওপর তিন দিক থেকে গুলি ও বোমা বর্ষণ শুরু করে। তবে স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের সামনে এক নলা বন্দুকের অসম সেই লড়াইয়ের এক পর্যায়ে পাকিস্তান সেনারা ইউনাইটেড ব্যাংকের ছাদে উঠে ছুনু, দোলন, হিটলু ও শাফিকে (তাঁদের আর কোন খোঁজ মেলেনি) ধরে নিয়ে যায়। ওই ভবন থেকেই ইউনাইটেড ব্যাংক ভবনের ছাদ লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে লুটিয়ে পড়েন টি. এম আইয়ুব টিটু।
আরও পড়ুনমাথায় গুলি লাগায় সেখানেই তার মৃত্যু হয়। পাকিস্তান সেনারা একই কায়দায় ঝাউতলা এলাকায় বোম্বে সাইকেল স্টোরের টিনের ছাদের ওপর আনোয়ারুল হক আজাদকে লক্ষ্য করে গুলি করলে তিনিও মারা যান। সহযোদ্ধারা টিটু ও আজাদের লাশ ফেলে ওই এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। এরপর পাকিস্তানী সেনারা বন্ধ রেলগেট ও মালবাহী বগির কারণে বাধার মুখে পড়েন। ক্ষিপ্ত হয়ে তারা রেলগেট সংলগ্ন একটি হোটেলে ঢুকে ঘুমন্ত ৪ কিশোরকে বেয়নট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। থানার দিকে অবস্থান নেওয়া পুলিশের রাইফেলগুলো ততক্ষণে সচল হয়ে ওঠে। প্রায় দুই ঘন্টা লড়াই শেষে হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। তারা শহরের বৃন্দাবনপাড়া এলাকায় সিএন্ডবির (সড়ক ও জনপথ) রেস্ট হাউজে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানী সেনাদের গুলিতে এক নম্বর রেলগেট এলাকায় অজ্ঞাতনামা আরও এক ব্যক্তি নিহত হন। পরে ওইদিন বিকেলেই পাকিস্তান বাহিনীর সেই আস্তান চারদিক থেকে ঘিরে আক্রমণ শুরু করে তরুণ যোদ্ধারা। হানাদাররাও পাল্টা জবাব দিতে থাকে। তাদের গুলিতে সুবিল ব্রীজের কাছে অবাঙালি মুক্তিযোদ্ধা কাবুল শহীদ হন। তবে প্রচন্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে ২৭ মার্চ রাতে পাক সেনারা পাততাড়ি গুটিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এর মাধ্যমে বগুড়া হানাদার মুক্ত হয়।’ ২ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা বগুড়ার মাঝিড়া এলাকায় অবস্থিত মিনি ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করেন। প্রচন্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তান বাহিনীর এক ক্যাপ্টেনসহ ১৯ সেনা সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। তবে তাদের ধরে আনতে গিয়ে লুকিয়ে থাকা অপর সেনা সদস্যের গুলিতে সেখানে মাসুদ নামে এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আটক পাকিস্তানী সেনা সদস্যদের পরে জেলগেটে নিয়ে হত্যা করা হয়। এর পর নজমুল হক নামে ইপিআরের (বর্তমানে বিজিবি) এক মেজরের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় সার্কিট হাউজে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়।
সেখানকার অয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎপরতার খবরাখবর তোতা নামে এক হাবিলদার মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিতেন। ১৩ এপ্রিল সেই হাবিলদার মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দেন পাকিস্তান বাহিনী চারদিক থেকে বগুড়া আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। দুই-একদিনের মধ্যেই তারা বিমান বাহিনীর সহায়তায় বগুড়ার দিকে রওনা হবে। এর পর পরই মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে যেতে শুরু করেন। আর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ১৬ এপ্রিল শুক্রবার পাকিস্তান সেনারা বগুড়া শহরে ঢুকে পড়ে। এর ফলে ২০ দিন মুক্ত থাকার পর বগুড়া পাকিস্তানী বাহিনীর দখলে চলে যায়। শহরে ঢোকার পথে তারা নির্বিচারে বহু নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করে।
মন্তব্য করুন