আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস
শহর ও গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার বড় পার্থক্য রয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার : বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার জিয়ানগরের থ্যালসমিয়া রোগী বত্রিশ বছরের ইমরান প্রতি মাসে তার শরীরে দুই ব্যাগ করে রক্ত নিতে হয়। শুধুমাত্র রক্তের জন্য তাকে বগুড়ায় এসে শহরের মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে একদিন বা দুইদিন ভর্তি হয়ে থাকতে হয়। বাড়ির অনতিদূরে উপজেলা হাসপাতাল থাকলেও সেখানে রক্তদাতার অভাবসহ আনুসঙ্গিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে তাকে শহরমুখী হতে হয়।
একই উপজেলার তালোড়া পৌরসভার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আমেনা বেগম বেশ কিছুদিন থেকে চোখের এক কর্নারে লাল হয়ে থাকাসহ চোখের প্রদাহ দেখা দেয়। কিন্ত ওই এলাকায় চোখের কোনো ভালো ডাক্তার না থাকায় তিনি ছেলের সঙ্গে বগুড়া শহরে এসে ডাক্তার দেখিয়েছেন। থ্যালাসমিয়াসহ একটু জটিল রোগী হলেই দেশের উপজেলা বা গ্রামাঞ্চলে মিলছে না ভালো স্বাস্থ্যসেবা।
তাই গ্রামের রোগীদের নির্ভর করতে হচ্ছে শহরের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর। বেশি জটিল রোগ হলে অনেক সময় জেলা শহরেও মেলে না চিকিৎসা। তাদের ছুটতে হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বাইরের হাসপাতালগুলোতে। আর সামর্থ্য না থাকলে চিকিৎসার অভাবে গ্রামেই ধুকে ধুকে মরতে হয়।
দেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ও মানের মধ্যে অসামঞ্জস্য বিদ্যমান আছে, যা বর্তমানে উদ্বেগ হিসাবে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশের বর্তমান চিত্র অনুযায়ী এই বৈষম্য মূলত অনেক ক্ষেত্রেই প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশ হেলথ্ ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী, শহুরে এলাকায় ৬৭ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার পাওয়া যায়, যেখানে গ্রামীণ এলাকায় এটি মাত্র ২৫ শতাংশ। এ ধরনের অসমতা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বড় পার্থক্য সৃষ্টি করে। আর স্বাস্থ্যখাতে এই বৈষম্য নিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস।
শহর ও গ্রাম অঞ্চলের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার বড় পার্থক্য দখা যায়। শহরাঞ্চলে উন্নত চিকিৎসা সুবিধা ও আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায়, তবে গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং অপ্রতুল সুযোগ রয়েছে। উচ্চ আয়ের মানুষ উন্নত হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সাথে সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন, কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এ ধরনের সুযোগ সীমিত। তারা সাধারণত স্থানীয় চিকিৎসকদের কাছে অথবা স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকেন। অনেক অঞ্চলে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা এবং শিক্ষা কম। ফলে, অনেক মানুষ স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানেন না এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব বুঝতে পারেন না।
নারীদের স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও বৈষম্য দেখা যায়, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় নারী স্বাস্থ্যসেবার অভাব, বিশেষত গর্ভবতী নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ কম। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার অভাবনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাব রয়েছে। ফলে, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির অবস্থা এবং সেবা প্রদান যথাযথভাবে করা সম্ভব হয় না। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলির প্রভাব বাড়ছে, যা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করছে।
এই সেক্টরের সেবা উচ্চমানের হলেও তা অনেক সময় অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী নয়। এই বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠনগুলোও কাজ করছে। তবে, এই সমস্যা সমাধানে আরও কার্যকরী নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রয়োজন।
আরও পড়ুনবগুড়া জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বগুড়ার উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর বর্হিবিভাগে ১২ লাখ ১২ হাজার ২২০জন রোগী স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন। অপরদিকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতাল ও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ২০২৪ সালে বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৩৫৮জন রোগী।
অপর দিকে ২০২৪ সালে উপজেলা হাসপাতালগুলোতে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭৮ হাজার ১১৬ জন এবং বগুড়া শহরের সরকারি দুটি হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় দেড় লাখ রোগী। এরমধ্যে শজিমেক হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখ ২৩ হাজার ৩৬৪ রোগী এবং মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৫ হাজার ৬১৭জন রোগী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে শহরের হাসপাতালগুলোর তুলনায় গ্রামের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক সংকটও রয়েছে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী উপজেলা হাসপাতালগুলোতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার, কনসালটেন্ট, মেডিকেল অফিসার, সহকারি সার্জন, ডেন্টাল সার্জনসহ ৩৩১টি চিকিৎসকের পদ রয়েছে। গত মাসে ২শটি পদে কর্মরত চিকিসক থাকলেও ১শ’ পদ শূন্য ছিলো। এছাড়া ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে ৩৩১টি পদের মধ্যে ১৯৭টি পদে কর্মরত চিকিৎসক থাকলেও ১৩৪টি পদে কোনো চিকিৎসক ছিলো না।
বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে ২৩৩টি পদের বিপরীতে ২১৩জন চিকিৎসক রয়েছেন। মাত্র ২০টি পদ শূন্য রয়েছে বলেন ওই হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ। এছাড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে অর্ধ শতাধিক পদের বিপরীতে মাত্র ৪ জন চিকিসকের পদ শূন্য রয়েছে বলে জানান ওই হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মিজানুর রহমান।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের মতে, এই বৈষম্য দূর করতে গ্রামীণ অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ডাক্তার ও নার্সদের উপস্থিতি বাড়ানো এবং সঠিকভাবে পরিচালিত স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করা জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ’ এর মত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশে গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষামূলক কর্মসূচি এবং কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীদের ভূমিকা বাড়ানো উচিত। এছাড়া, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা এবং ডিজিটাল হেলথ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন।
মন্তব্য করুন