এড. মোঃ মোজাম্মেল হক
আশির দশকে যারা এসএসসি পাশ করেছে তাদের বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে একটি গল্পগুচ্ছের বই পড়তে হতো, যার নাম ছিলো কথা বিচিত্রা। সেই কথা বিচিত্রায় রবীন্দ্রনাথের ছুটি নামে একটি ছোট গল্প ছিলো। গল্পের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছিলো এই রকম, বিশ^ম্ভর বাবু বহুদিন পর ভগিনীর বাড়িতে বেড়াইতে আসিয়াছেন, ইতিমধ্যে ভগ্নিপতি গত হইয়াছেন, বড় ভাগ্নে খুবই দুষ্ট, দুই ছেলেকে নিয়ে বোন অতিষ্ঠ, যার কারণে বিশ^ম্ভর বাবু বড় ভাগ্নে ফটিককে কোলকাতায় নিজের বাড়িতে নিয়ে লেখাপড়া শেখার জন্যে প্রস্তাব দিলে বড় ভাগ্নে ফটিক আগ্রহভরে রাজি হয়ে যায়।
অত:পর যাওয়ার সময় ফটিক তার ছোট ভাই মাখনকে আনন্দের ঔদার্য-বশত তাহার ছিপ ঘুড়ি লাটাই পুত্রপৌত্রাদিক্রমে ভোগদখল করিবার পুরা অধিকার দিয়া যায়, অথচ কিছুদিন আগেও গোটা পৃথিবীর বিনিময়েও ফটিক মাখনকে ঐ সকল খেলনা দিতো না।
মানুষ আনন্দে আত্মহারা হলে অনেক কিছুই ত্যাগ করে, কিন্তু মানুষ দুঃখের সময়েও অনেক কিছু স্বার্থহীনভাবেও ত্যাগ করে তারও প্রমাণ এবার পাওয়া গেল। গল্পটা বলার কারণ গত ২৪শে আগষ্ট দৈনিক করতোয়া পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি খবর বের হয়, যার শিরোনাম ছিলো টিএসসিতে মানবতার ফেরিওয়ালারা, নিজের জমানো ও সাইকেল কেনার টাকা দিল ছোট্ট ইহান ও মিম।
খবরটি অনেকেরই দৃষ্টিগোচর হয়েছে,খবরটি আশাবাদী মানুষকে আবেগাপ্লুত করেছে, সাইকেল কেনার জন্যে জমানো টাকা ছোট্ট শিশুর পক্ষে বানভাসি মানুষের জন্য দান করা কম ত্যাগ স্বীকারের কথা নয়। এটা শুধু একটি খবর নয়, এটা একটি বিশাল মেসেস, সেব্যাপারে পরে বলছি। দেশের ১১টি জেলায় ব্যাপক বন্যা হয়েছে, বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে মানুষের জীবন।
বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫২ লাখেরও বেশী মানুষ। সেখানে মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করছে। ইতিমধ্যেই সেখানে ২০ জনেরও বেশী মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বন্যায় মানুষজন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। পুকুরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে, জমির ফসল, হাঁস-মুরগীর খামার তলিয়ে গেছে, গবাদি পশু ভেসে গেছে। এতো প্রলয়ঙ্করী বন্যা যে, মানুষ মারা গেলে তাদের যে কবর দিবে সেই শুকনো জমিনটুকু পর্যন্ত নেই সেখানে।
অনেকের সোনালী স্বপ্ন নিমেষেই ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ,বন্যার সঙ্গে দেখা দিয়েছে অতিবৃষ্টি, ঠিক যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। পানি বিশেষজ্ঞরা বলেন, উজান দেশের ছেড়ে দেওয়া পানিতে আমাদের দেশের বন্যা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। এই সকল নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আমরা কখনই পাই নাই। শুকনো মৌশুমে যে পানি পাওয়ার কথা আমরা সে পানি পাই না, অথচ বর্ষাকালে যখন আমাদের পানির প্রয়োজন নাই তখন আমাদেরকে পানি দিয়ে শুধু বিপাকেই ফেলছে না, ভারত আমাদের সঙ্গে চরম অমানবিক আচরণ করছে।
১৫/১৬ বছর যাবৎ দেশে একটি নতজানু সরকার ক্ষমতায় ছিলো, তারা কোন সময়েই পানির ন্যায্যা হিস্যার জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে কোন দাবী-দাওয়া তুলে নাই, ফলে প্রতিবেশী দেশ আরাম আয়েশেই ইচ্ছে মতো একতরফাভাবে তারা অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহার করছে।
আর ভারতের তাবেদার ও নতজানু শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্যে এদেশের জনগণের মতামত উপেক্ষা করে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করে এবং স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ শাসন করতে থাকে। বিরোধী দল সেই স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করেও যখন কোন কিছুই করতে পারছিলো না তখনই শুরু হয় ছাত্রদের কোটা বিরোধী আন্দোলন।
পরে ছাত্রদের আন্দোলন সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্রদের আন্দোলনের ক্ষমতা সম্পর্কে শেখ হাসিনার কোন সম্মুখ জ্ঞান ছিলো না। ৬৬ সনের ছাত্রদের আন্দোলনে আইয়ুব খান লেজ গুটাতে বাধ্য হয়। ৬৯এ ছাত্র আন্দোলনে আসাদের রক্তে দেশ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যায়। ৭১এ স্বাধীনতা, ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের পূরোধা ছিলো ছাত্ররা এবং সর্বশেষ ২০২৪ এর ছাত্র আন্দোলন এবং স্বৈরাচারের পতন ছাত্রদের দ্বারাই সম্ভব হয়, পিছনেতো রাজনৈতিক দল ছিলোই।
সরকার ছাত্র আন্দোলন থেকে কোন শিক্ষা নেয় না, ফলে যা হবার তাই হয়েছে। তবে এবারের ছাত্র আন্দোলনের গতিবেগটা একটু আলাদা, তারা আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলেও আন্দোলনের মাঠ থেকে বিদায় হয়নি, তারা এখনও মাঠে আছে। এবারের বন্যায় ছাত্ররা যেভাবে ত্রাণ সংগ্রহ করছে তা থেকেই বোঝা যায় তারা মাঠ ছেড়ে যায়নি।
দেশের সাধারণ মানুষ মানবতার এই ফেরিওয়ালাদের ডাকে সাড়া দিয়ে যে যেভাবে পারছে সে সেইভাবে বানভাসিদের জন্য সাহায্য করছে। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তারা দিন রাত পরিশ্রম করে এই ত্রাণ নিচ্ছে। সঙ্গেতো আপামর জনতা আছেই। রাজনৈতিক দলগুলোও বসে নেই, তাঁরাও সাধ্যমতো ত্রাণ দিচ্ছে।
আগে দেশে বহুবার বন্যা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলো দুই একদিন ত্রাণ তুলে বন্যা দুর্গত এলাকায় পৌঁছে দিত কিন্তু এবারের চিত্রটা ভিন্ন। আগে মানুষ ত্রাণ দেওয়ার জন্যে খুব বেশী সাড়া দেয়নি কিন্তু এবার ছাত্রদের ডাকে দেশের আবাল বৃদ্ধ বণিতা সবাই তাদেরকে সাহায্য করছে, তাদের কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছে একটি জেনারেশন তৈরী হচ্ছে, যারা দেশের সংকটময় মুহূর্তে মানুষের পাশে দাঁড়াবে এবং এটাই এই জেনারেশনের মেসেস। ইতিমধ্যেই তারা বানভাসি মানুষের জন্যে কাজ করে প্রমাণ করেছে মানুষ মানুষের জন্যে।
লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক
বগুড়া জেলা এ্যাডভোকেট বার সমিতি
01711-197719|
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।