এড. মোঃ মোজাম্মেল হক
যখন এই লেখাটা লিখছি তখন অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের বয়স প্রায় একমাসের মতো। আইন পেশায় থাকার কারণে এবং মাঝে মধ্যে পত্রিকায় লেখালেখির কারণে অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে। এই সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে, দুই বছর না তিন বছর না আরও বেশি, এ ব্যাপারে সংবিধান কি বলে। আপনারা যেহেতু সংবিধান নিয়ে আইন ব্যবসা করেন সেহেতু আপনারা বিষয়গুলো ভালো করে বলতে পারবেন।
প্রথমেই বলে রাখি সংবিধানের চর্চা নিম্ন আদালতে হয় না বললেই চলে, সংবিধানের বরখেলাপ কিম্বা সংবিধানের আলোকে কোন প্রতিকার পেতে গেলে হাইকোর্টে যেতে হয়, সুতরাং সংবিধান নিয়ে আমাদের নাড়াচাড়া খুব কমই হয়।
তবে একটা বিষয় আমাকে খুবই আশা জাগায় আর তাহলো এখন একজন স্বল্প শিক্ষিত মানুষ কিম্বা সাধারণ একজন মানুষও দেশের খবর রাখে, দেশ নিয়ে ভাবে, দেশ কোন দিকে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে দেশের হাল-হকিকত কি হবে, বর্হিবিশে^র সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, আমাদের প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি তখন আবেগ-আপ্লুত হই, মনে আশা জাগে, মনে হয় আমরা ঠিকঠাক পথেই এগিয়ে যাচ্ছি, কারণ আমরা কিছুটা হলেও আগের চেয়ে সচেতন হয়েছি, দেশ নিয়ে ভাবতে শিখেছি। সচেতনতার অভাবে প্রায় তেইশ-চব্বিশ বছর পশ্চিমা শাসকগোষ্টি আমাদের শোষন করেছে, তারও আগে আমরা বৃটিশদের শৃঙ্খলে ছিলাম প্রায় দুইশো বছর। একটি জাতি প্রায় আড়াইশো বছর পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে দেশটা স্বাধীন করেছে। স্বাধীনতার প্রায় ৫৩ বছর পার হয়ে গেলেও প্রকৃত অর্থে কি আমরা স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে পারছি?
অনেক দাবির মধ্যে মূলত ভোটের অধিকারের দাবিতে আমরা সোচ্চার হই, ভোটের ফলাফল মত আমরা ক্ষমতা না পাওয়ায় জালিমশাহীর বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি, যে অধিকার আদায়ের কারণে যুদ্ধ করেছিলাম সে অধিকার আদায় কি আমাদের হয়েছে ? দেশে ১৯৯১ ও ২০০১ সনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে ভোট উপহার দিয়েছে সে ভোট ছাড়া আর যে সকল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভোট করেছেন সে সকল ভোটের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে দেশের অনেক মানুষের কাছেই তা আজও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। মূলত স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদ বন্দুকের নলের জোরে ক্ষমতায় এসে স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ শাসন করতে থাকে।
এই স্বৈরাচার জগদ্দল পাথরকে সরানোর জন্যে দেশের সকল রাজনৈতিক দল আন্দোলন শুরু করে, দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর এক সময় এইচ এম এরশাদ ১৯৯০ সনে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তখন এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা কাকে দিবেন সে প্রশ্ন সামনে এসে যায়।
সেই সময়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধভাবে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও লড়াই সংগ্রাম করছিলেন, মূলত তিনটি রাজনৈতিক জোটের সিদ্ধান্তক্রমে এবং তিন জোটের রূপরেখায় সেই সময়ে জাতির বিশেষ প্রয়োজনে সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি জনাব সাহাবুদ্দীন আহমদকে তত্ত্ববধায়ক সরকারের প্রধান করা হয় এবং তিনি ৯০ দিনের মধ্যে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করে দায়িত্ব ছেড়ে স্বপদে ফিরে যাওয়ার শর্ত দেন।
সমস্ত রাজনৈতিক দল সে দাবি মেনে নেয়। নতুন কনসেপ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনে শুরু হয় ভোটের যুদ্ধ। ১৯৯১ সনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনে একটি নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে বিএনপি সরকার গঠন করে সংসদে বিল এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমস্ত কাজের বৈধতা দেয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশিত করে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ২০১১ সনে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে বিল এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি করে দলীয় সরকারের অধিনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন।
যদিও আওয়ামী লীগ দাবি করেন উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তক্রমে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। মূলত তাদের এ বক্তব্য সঠিক নহে কারণ বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের ঐ মামলার রায়ে অন্তত দুইটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনে হওয়ার নির্দেশনা ছিলো। আওয়ামী লীগ সে সকল নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্ষমতার জোরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়।
আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলো, তথাপিয় তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিজেদের সুবিধার জন্যে রহিত করে দেন। আওয়ামী লীগ যখন ২০০৯ সনে ক্ষমতায় আসেন তখন ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ছিলেন। ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার মূলত দেশের প্রধান সেনাপতি মঈন ইউ আহমেদের সেনা সমর্থিত সরকার ছিলেন।
সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভোটের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিএনপি সহ অন্যান্য দল প্রশ্ন তুলে আন্দোলন করতে থাকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার মূলত ৩ মাস থেকে ৬ মাসের মধ্যে ভোট সমাপ্ত করে দায়িত্ব থেকে চলে যাওয়ার কথা থাকলেও ড. ফখরুদ্দীনের সরকার ২ বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলো । ১৯৯০ সনের ৬ই ডিসেম্বর হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদ পদত্যাগ করলেও ৫ম সংসদ নির্বাচন হয় ২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ তারিখে। তারপর বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ স্বপদে ফিরে যান।
আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রহিত করার কারনে সেই বিষয়ে আমি একটি উপসম্পাদকীয়তে লিখেছিলাম অন্ধের লাঠি ফেলা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। একটি অন্ধলোক সারা জীবন লাঠির সাহায্যে চলা ফেরা করে, লাঠি ছাড়া তার এক মূহুর্ত চলতো না অথচ ঐ লোকটি যখন চোখের আলো ফিরে পায় তখন প্রথমেই যে কাজটি করে তাহলো তার হাতের লাঠিটাই আগে ফেলে দেয়, লাঠিটাকে সে বোঝা মনে করে।
আওয়ামী লীগ সরকার ঠিক তাই করেছে, অথচ আওয়ামী লীগ দাবি করতো আমরা মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য লড়াই করছি, তাদের এই দাবি শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজি ছিলো, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে একটার পর একটা বিতর্কিত নির্বাচন করে তারা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখে।
এই সকল বেআইনী কাজে সহায়তা করে পাচাটা প্রশাসনের কিছু লোক, কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, কিছু অসৎ ব্যবসায়ী, কিছু পুলিশের লোক, কিছু নাম সর্বস্ব পার্টির তথাকথিক নেতা ও এক শ্রেণীর মতলবাজ সাংবাদিক উচ্ছিষ্টভোগী সাংবাদিক। এই সকল লোকজন যদি এই আওয়ামী লীগ সরকারকে সহযোগিতা না করতো তাহলে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪ সালেই হাড়ি-পাতিল তুলে দৌড়ানি দিতো তারা ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পেত না।
২০১৪ সনের ভোট ছিলো ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভোট। ২০১৮ সনের ভোট ছিলো নিশি রাতের ভোট, যেটা নির্বাচন কমিশন পরবর্তীতে নিজেই স্বীকার করেছেন, আর ২০২৪ সনের ৭ই জানুয়ারির ভোট ছিলো ডামি ভোট, যেখানে নিজেরা নিজেরাই প্রার্থী ছিলো, অন্য কোন দল সেই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে নাই। দীর্ঘদিনের সেই সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে কেও কথা বলতে পারে নাই।
মানুষের ভোটাধিকার ছিলো না, মানুষের বাক স্বাধীনতা ছিলো না, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ছিলো না, ছিলো না মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। আওয়ামী লীগ সরকার ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশ চালাতো, ফ্যাসিবাদী শব্দটা তখন উচ্চরণ করা যেত না, বলতে হতো কর্তৃত্ববাদী সরকার। মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার থাকা সত্বেও আজকের মতো সেদিন লিখতে পারতাম না। ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে ১৯৭৪ সনে দেশের ৪টি পত্রিকা রেখে সমস্ত পত্রিকা বন্দ করে দেয়, বিশেষ ক্ষমতা আইন করে মানুষকে বিনা বিচারে আটকাদেশ দিয়ে মাসের পর মাস কারাগারে অবরুদ্ধ করে রাখে।
এটাই ছিলো আওয়ামী লীগের বিরোধী মত দমনের একমাত্র পথ। ক্ষমতা থেকে পালানোর আগ পর্যন্ত এটাই ছিলো তাদের শক্তি। অবশেষে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর কোটা আন্দোলন নামে একটি আন্দোলন থেকে এক দফার সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। প্রায় ৩৬ দিনের লাগাতার আন্দোলনের পর শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
এমনভাবে পালায় যে, রান্না করা ভাত পর্যন্ত না খেয়েই পালাতে বাধ্য হন। ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি যখন লক্ষণ সেনের প্রাসাদ আক্রমন করেন তখন লক্ষণ সেন পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেন, ঠিক হাসিনাও একই কাজ করেন। তারপর ছাত্র-জনতার বিজয় হয়। ফ্যাসিষ্ট হাসিনা সরকারের পতন হয়। প্রায় ১০০০ ছাত্র-জনতার জীবনের বিনিময়ে স্বৈরাচারের পতন হয়।
ছাত্র-জনতার ইচ্ছানূয়ায়ী নোবেল বিজয়ী একমাত্র বাংলাদেশী ড. অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ গ্রহণ করে দেশ পরিচালনা করছেন। অনেকে এটাকে বিপ্লবী সরকারও বলছে। প্রেসের এক প্রম্ন ছিলো অন্তর্বর্তীকালিন সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে, উত্তরে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন যতদিন জনগণ চাইবে ততদিন এই সরকার ক্ষমতায় থাকবেন। জনগণ না চাইলে এই সরকার একদিনও ক্ষমতায় থাকবে না।
তবে একথা ঠিক প্রায় ১৬ বৎসর যাবৎ বিগত ফ্যাসিষ্ট সরকার ক্ষমতায় ছিলো, প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘাপটি মেরে তাদের লোকজন রয়ে গেছে, এই সকল জজ্ঞাল সরাতে হবে, তাদেরকে অপসারন করতে হবে, প্রয়োজনে এমনভাবে সংস্কার করতে হবে যাতে তারা ভবিষ্যতে আর যেন কোন ষড়যন্ত্র করতে না পারে। এই সকল ষড়যন্ত্রকারীদের সমূলে উৎপাটন করে রাজনৈতিক অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা এই সরকার করে যাবেন জাতি এটা প্রত্যাশা করে, সময়টার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বগুড়া জেলা এ্যাডভোকেটস্ বার সমিতি।
01711-197719
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।