বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদ্ষ্টো ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তিস্তা নদীর পানি বন্টন সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক আইন মানতে হবে। তিনি বলেন, তিস্তা ইস্যুর সমাধান হতেই হবে। ভারতের বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে (পিটিআই) দেওয়া সাক্ষাতকারে ড. ইউনূস বলেন, এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে তার সরকার আলোচনা করবে। কারণ এটি ঝুলে থাকায় কোনো দেশই লাভবান হচ্ছে না।
পিটিআইয়ের ওয়েবসাইটে গত শুক্রবার সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ পায়। সাক্ষাতকারে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক নিয়েও কথা বলেন ড. ইউনূস। ঢাকায় সরকারি বাসভবনে দেওয়া সাক্ষাতকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি যদি জানি, আমি কতটুকু পানি পাব, সেটা ভালো হতো। এমনকি পরিণাম নিয়ে যদি আমি খুশি নাও হই, তাতেও কোনো সমস্যা নেই।
এই বিষয়টি সমাধান হতেই হবে। কারণ পানি বন্টনের বিষয়টি নিয়ে বসে থাকার ফলে এতে কোনো কাজ হচ্ছে না। তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ভারতকে চাপ দেবে কি না -পিটিআইয়ের এমন প্রশ্নে ড. ইউনূস বলেন, ‘চাপ’ শব্দটি অনেক বড়। আমি কথা বলছি না। আমরা আলোচনা করব। আমাদের এক সঙ্গে বসে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
আমরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। আমাদের দীর্ঘ নতজানু পররাষ্ট্র নীতির দরুণ ভারতের সঙ্গে আমাদের ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বন্টনের কাজটি আজও সম্পন্ন করা যায়নি। ভারত তার প্রয়োজনে এসব নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ করে। শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে আমাদের নদীগুলোকে পানি শূন্য করে ফেলে।
আবার বর্ষার সময় বাঁধ খুলে নিয়ে বিপুল জলরাশি বাংলাদেশে ছেড়ে দেয়। ফলে ডুবে মরে বাংলাদেশ। সম্প্রতি ত্রিপুরার বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশে অকাল বন্যার ভয়াবহতা তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমরা আশাবাদী প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এ ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন দেশের স্বার্থে। এককালের প্রমত্তা পদ্মা আর নেই। শীতকালে শুকিয়ে যায়। গরুর গাড়ি এপার-ওপার করে। মানুষও হেঁটে পারাপার হয়। ভারতের ফারাক্কা বাঁধ প্রমত্তা পদ্মাকে খেয়ে ফেলেছে।
তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রের অনেক কিছুই আজ কেবল স্মৃতি। বড় বড় স্টিমার চলাচল করত নদী দুটিতে। নদীকেন্দ্রিক বাণিজ্যের কারণে উত্তরবঙ্গের অনেক বন্দর ছিল জমজমাট। এখন বছরের বেশির ভাগ সময় নদী দুটি শুকিয়ে থাকে। নৌকাও চলতে পারে না। ভারতের গজলডোবা বাঁধ নদী দুটির এ অপমৃত্যুর কারণ। নদীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মরছে নদী কেন্দ্রিক বাংলাদেশও। উত্তরবঙ্গে শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। শস্য উৎপাদনে পড়ছে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব।
ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। শুষ্ক মৌসুমে গভীর নলকূপেও ঠিকমতো পানি ওঠে না। ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসা বাংলাদেশের অর্ধশতাধিক নদীরই আজ এমন দুরবস্থা। শীতকালে বেশির ভাগ নদীতেই পানি প্রবাহ থাকে না। ফলে দক্ষিণবঙ্গে সমুদ্রের নোনা পানি ক্রমেই দেশের অভ্যন্তরে বিস্তৃত হচ্ছে। সেখানেও কৃষি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
ফলে এটা আজ অবধারিত যে অভিন্ন নদীগুলোর পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা না গেলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ক্রমেই হুমকির মুখে পড়বে। অথচ দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে দীর্ঘকাল ধরে আলাপ-আলোচনা চললেও বাংলাদেশের জন্য সুখবর কখনও ছিল না। বরং দু:সংবাদই পেয়ে থাকে বেশি। ভারত অভিন্ন নদীগুলোর উজানে এক তরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। অভিন্ন নদীগুলোর পানি সমস্যা, বিশেষ করে তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে ভারত আমাদের সুনির্দিষ্ট আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও তা রক্ষা করেনি। একের পর এক নানা অজুহাতে তারা কেবল সময়ক্ষেপণ করছে।
অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের মরুকরণ প্রক্রিয়া ও দক্ষিণবঙ্গে নোনা পানির বিস্তৃতি ক্রমেই বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করছে। এ সমস্যা ১৭ কোটি মানুষের বাঁচা-মরার সমস্যা। এ নিয়ে কালক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে নতুন করে চিন্তা ভাবনা করতে হবে এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ার কথাও ভাবতে হবে।
উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও অর্থনীতি শুধু নয়, জলবায়ুর ওপরও তিস্তার প্রভাব রয়েছে। কাজেই একটি এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। তাই, তিস্তা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শক্ত অবস্থানকে বাংলাদেশের জনগণ মন-প্রাণ দিয়ে সমর্থন করে। ড. ইউনূসের পাশে গোটা বাংলাদেশ একাট্টা।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।