সর্ব যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সংগঠক ও সমাজসেবক মুহাম্মদ (স.)
পৃথিবী যখন ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত, আর্থ সামাজিক, ধর্মীয় সংস্কৃতিক অবস্থা যখন নৈরাজ্যের প্রান্ত সীমায় উপনীত। মানবিক মূল্যবোধ ও আর্দশিক চেতনা যখন পুরোপুরি ভুলুণ্ঠিত। অন্যায় অত্যাচার অবিচারসহ হাজারো অশ্লীলতা ও পাপ পংকিলতার অতল তলে নিমজ্জিত গোটা বিশ্বমানব।
খসরু ভারভেজ শাসিত পারস্য সভ্যতা, হিরক্লিয়াস শাসিত রোমান সভ্যতা, শশাংক শাসিত বঙ্গীয় সভ্যতা যখন কালের গতিধারায় তাদের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ও অন্তর্নিহিত সুষমা হারিয়ে যখন পান্ডুর হয়ে গেছে। প্রভুর বন্দনা ও স্তুতিবাদ দিয়ে বনি আদম যখন শিরক-বিদআত ও মানব রচিত মতবাদ এবং গোত্র সর্দারদের অনৈতিক শাসনে দিশেহারা ঠিক সেই মুহূর্তে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে এ ধরা পৃষ্ঠে আগমন করে সর্বকালের সর্ব যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মহাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ চৌকষ সংগঠক নবী ও রাসুলদের সর্দার সাইয়েদুল মোরছালিন রহমাতুললিন আলামিন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (স:) আলাইহিওয়া ছাল্লাম।
এখানে মহানবী (স:) এর বিশাল জীবন আলোচনা অসম্ভব তাই মহানবী (স:) এর জীবন প্রবাহ থেকে সাংগঠনিক দিক নিয়ে অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনা জ্ঞানি পাঠক সমাজের নিকট উপস্থাপন করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
মনে রাখা দরকার যে একজন ভাল সংগঠক ও শ্রেষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন সততার। বাল্য কালেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স:) সততার গুনে ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। যার কারণে বর্বর জাহিলী যুগের অমানুষগুলোও তাকে উপাধি দিয়েছে আল-আমিন (বিশ্বাসী) হিসাবে। সে সময়ের বালকদের ছিলেন সর্দার বা নেতা। তাই তারা তাদের অর্জিত সম্পদ গচ্ছিত রাখত আল আমিন (মুহাম্মদ স:) এর নিকট।
বছরের নির্দিষ্ট সময়ে হিজাব এদেশে বিশেষ বিশেষ স্থানে আরব অধিবাসীদের মেলা ও সমাবেশ হতো। এসব মেলায় বাণিজ্য সরঞ্জামাদি ক্রয়-বিক্রয়সহ সাহিত্য প্রতিযোগিতা এবং তাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনাসহ ঝগড়া-ফিৎনা ফাসাদের সৃষ্টি হতো। এসব মেলার মধ্যে ওকাজ নামক মেলাটি ছিল সর্বপ্রধান। এ ওকাজ মেলার ধ্বংসাত্মক পরিনামেই সংঘটিত হয় জংগে ফিজার বা ফিজারের যুদ্ধ।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স:) যখন শিশুকাল ও কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেন। তখনই শুরু হয় ফিজারের যুদ্ধ যা ৫ বছর স্থায়ী ছিল। যুবক আল আমিনকে উপস্থিত হতে হয় এ যুদ্ধের শেষভাগে। তবে তিনি কোন অস্ত্র ব্যবহার করেননি, মহানবী (সঃ) বলেন আমি আমার পিতৃগণকে শত্রু পক্ষের তীর হতে রক্ষা করেছিলাম। ঐতিহাসিক বাহেলী বলেন ফিজার যুদ্ধে যুবক মুহাম্মদ (স:) আদৌ অস্ত্র ব্যবহার করেনি।
বস্তুত এ যুদ্ধে কুরাইশ বংশের কোন অন্যায় ছিলো না। তাদের ওপর অত্যাচারের কারণেই তারা সমর ক্ষেত্রে উপস্থিত হতে বাধ্য হয়। প্রিয় নবী মুহাম্মদ (স:) যুদ্ধের বিভীষিকাময় করুণ দৃশ্য দেখে মর্মাহত হন। আহা! পাঁচটি বছর কত হাহাকার ও ক্রন্দনের রোল উঠেছে।
কত শিশু ইয়াতিম হয়েছে। কত স্ত্রী বিধবা হয়েছে। এসব নৃশংসতা নিষ্ঠুরতা ও বিভীষিকা দেখে রহমতের নবী (স:) এর কোমল হৃদয় কেঁদে উঠলো। শিউরে উঠলো তার দেহমন। এ অন্যায় জুলুম ও জিঘাংসার প্রতিকারের জন্য প্রতিজ্ঞা করলেন। যে কোন মূল্যে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আনতে হবে। যুবক মুহাম্মদ (স:) গভীর চিন্তা করলেন। গভীর ভাবনায় এক পর্যায়ে স্থির করলেন শান্তির জন্য প্রয়োজন সৎ মতাদর্শ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা। তাই তিনি যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি যুব সংঘ তৈরীর প্রচেষ্টা করেন।
মানব প্রেমিক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স:) ৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে কনিষ্ঠ পিতৃব্য যবাইর সহ হাশিম ও জোহরা প্রভৃতি বংশের কতিপয় উৎসাহী যুবকদের নিয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে জাদ আনের গৃহে একটি যুব সমাবেশে সমবেত হন। সুঠাম যুবক আল আমিনের ডাকে মক্কার তরুণ যুব সমাজ ঝাকে ঝাকে জমায়েত হয়। সমাজ থেকে সকল অন্যায় ও অত্যাচার দূর করার জন্য একটি শান্তিসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন।
সংঘের বিশিষ্ট সদস্যবর্গের নাম ছিলো ফযল, ফাযিল, ফাযাইল ও মুফাযযল। এ চার বিশিষ্ট সদস্য বর্গের নামে সেই সংস্থার নামকরণ করা হয় হিলফুল ফুযুল বা “শান্তিসংঘ” যার অর্থ ফযলদের প্রতিজ্ঞা। সেই সেবা সংস্থার সাংবিধানিক ধারা সমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ধারা ছিলো
এরকম (১) আমরা দেশের অশান্তি দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
(২) পরদেশী লোকদের ধনসম্পদ ও ইজ্জত সম্মান-সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করবো।
(৩) দরিদ্র ও অসহায় লোকদের সহায়তা করতে আমরা কখনো কুন্ঠিত হবো না
(৪) অত্যাচারীর অত্যাচারকে দমিত ও ব্যাহত এবং দুর্বল নিপীড়িত দুঃখী লোকদেরকে যালিমের হিংস্র থাবা হতে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করবো। কোন কোন ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে সমবেত জনগণ মহান স্রষ্টার নামে অসহায়কে সাহায্য ও অত্যাচারিতের পক্ষ সমর্থন করার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। (হালবী-১/১৩০)
এই শান্তি সংঘের মাধ্যমে যুব সংগঠক আল আমিন মুহাম্মদ (স:) মক্কায় যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই হিলফুল ফুযুল বা শান্তিসংঘেই হচ্ছে বিশ্ব ইতিহাসে সর্বপ্রথম সেবা সংস্থা। এই শান্তি সংঘ প্রতিষ্ঠা করে মহানবী (স:) পৃথিবীর ইতিহাসে যুবক ও তরুণ সমাজের জন্য এক অনুপম আদর্শ স্থাপন করে গেছেন।
যুবক নবী (স:) এর গড়া হিলফুল ফুযুল যুব সংগঠন আমাদের শিক্ষা দেয় সত্য ও মঙ্গলকে গ্রহণ করে অসত্য ও অমঙ্গলের বিরুদ্ধে জীবন বাজী রেখে প্রচেষ্টা চালানো। এরপর ৪০ বছর বয়সে ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে নবুওয়াত প্রাপ্তির পরে মহানবী (স:) দ্বীনি দাওয়াতি কাজে লিপ্ত হন।
শুরু হয় আদর্শ যুব সংগঠক মুহাম্মদ (স:) এর ওপর কঠিন নির্যাতন। শ্রেষ্ঠ সংগঠক মহানবী (স:) নির্যাতনে ধৈর্যহারা না হয়ে সব সমস্যার মোকাবেলা করেছেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স:) সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন হিজরতের মাধ্যমে। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হিজরত করে মদিনায় নব্য রাষ্ট্র গঠন করেন।
আরও পড়ুনমদিনায় হিজরতের পর মহা নবী (স:) সর্বাধিকারের ভিত্তিতে ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমেই রচনা করলেন সংবিধান। যা মদিনা সনদ নামে পরিচিত। এ সনদে ৪৭টি ধারা রেখেছিলেন। কোন কোন বর্ণনায় ৫৩টি ধারার কথা পাওয়া যায়।
মদিনা সনদ নামে খ্যাত এ দলিল বিশ্ববিখ্যাত ইতিহাসবিদ ড: হামিদুল্লাহ বলেন ইয়ে দুনিয়া কি পহেলী তাইরিরী দপ্তর হ্যায়। অর্থাৎ এটা দুনিয়ার ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান। এ সংবিধানের মাধ্যমে ইহুদী খৃষ্টানগণ স্ব-স্ব ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের অধিকার পেল এবং তাদের জানমাল ইজ্জত রক্ষায় রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি ঘোষণা হলো।
এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক মউর বলেন “মদীনা সনদ শুধু সে যুগের নয় বরং সর্ব যুগে মুহাম্মদ (স:) এর বিরাট মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে।” এই মদিনা সনদের মাধ্যমে মহানবী (স:) এর শ্রেষ্ঠ সংগঠক হিসাবে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে চির বিরল। তিনি শ্রেষ্ঠ সংগঠক হিসেবেই নিজেকে তৈরি করেন। যা পরবর্তীতে হয়ে যায় শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র নায়ক।
এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক পি.কে হিট্টি বলেন আরবের ইতিহাসে রক্তের সম্পর্কের চাইতে বরং ধর্মের ভিত্তিতে সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনের এটাই প্রথম প্রচেষ্টা। মদিনা প্রজাতন্ত্রই পরবর্তীতে বিশাল ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল স্থাপন করে। এরপর ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (স:) এর হুদায় বিয়া চুক্তির মাধ্যমে দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। মহানবী (স:) এই চুক্তিটি প্রাথমিকভাবে মুসলমানদের বিপক্ষে থাকলেও পরবর্তীতে ছিলো বিশাল সফলতা।
এ কারণে বলা হয়েছে ফাতহুম মোবিন বা প্রকাশ্য বিজয়। পরবর্তীতে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয় করেন এবং ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিদায় হজ্জে নাতিদীর্ঘ ভাষণ দেন। মানব জাতীর যাবতীয় সমস্যার সমাধান রয়েছে এই ভাষণে। শ্রেষ্ঠ নেতা, শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র নায়ক, শ্রেষ্ঠ সংগঠক মহানবী হযরত মহাম্মদ (স:) এর প্রতিটি পদক্ষেপেই আমরা আদর্শ সংগঠকের পরিচয় পাই। ইতিহাসে যার জুড়ি নেই।
এ কারণেই ইউরোপীয় লেখক মাইকেল এইচ হার্ট দ্যা হান্ড্রেড গ্রন্থে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ জন মহা মানবদের জীবনী গ্রন্থে প্রথমে যার নাম লিখেছেন তিনি হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ (স:)। বইয়ের ভূমিকায় তিনি লেখেন পৃথিবীর একশজন অত্যন্ত প্রভাবশালি ব্যক্তির তালিকায় আমি মুহাম্মদের নাম কেন এক নাম্বারে বাছাই করলাম তা আমার পাঠকদের বিস্মিত করবে এবং অন্যরা প্রশ্নও তুলতে পারে। কিন্তু তিনি হলেন ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় ও ইহজাগতিক উভয় দিক দিয়ে চরম ভাবে সফল কাজ।
একজন আদর্শ নেতা বা ভাল সংগঠকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক্ষমা। মহানবী (স:) মক্কা বিজয়ের পর শত্রুদের প্রতিশোধ গ্রহণ না করে সাধারণ ক্ষমা করে দিয়ে পৃথিবী অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ঐতিহাসিক মউর বলেন “এ মহান দৃশ্যে মুগ্ধ হয়ে আপামর মক্কাবাসী স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ধন্য হলো।”
একটি কথা না বললেই নয় আজ সভ্যতা বলতে চলছে আধিপত্য বিস্তারের নির্লজ্জ তৎপরতা, মানব কল্যাণে নেমে এসেছে নানামুখী মতবাদ। লেলিন, কার্লমার্কস, হেগেট, ডারউইন, রুশো, মাওসেতুং সহ প্রভূত দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের বিভ্রান্তিকর মতবাদে মানব জাতি ভুগছে হতাশায়।
তারা শান্তির বার্তা প্রদানের দুঃসাহস প্রদান করলেও তারা হয়েছে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও পর্যবসিত। অন্যদিকে মহাবিশ্বে চলছে অশান্তির দাবদাহ-মানব কল্যাণের কথা পিছনে রেখে মহাবিশ্ব আজ অস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত। বর্তমানে শিক্ষা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও নতুন নতুন আবিষ্কার মানুষের মাঝে শান্তি দিতে হয়েছে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
আজ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মানুষকে ভালবাসার পরিবর্তে উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলো অধিক শক্তিশালী বোমা নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে যুদ্ধের জন্য। পুরো বিশ্বকে কয়েক হাজার বার ধ্বংস করা যাবে এমন অস্ত্র আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। অথচ এই অশান্ত পৃথিবীকে শান্ত করা বা বণি আদমকে শান্তি বা মুক্তি দেয়ার কোন কৌশল আজ পর্যন্ত কোন দার্শনিক বা বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেনি।
অথচ আজ থেকে ১৫০০ বছর আগে আমাদের পিয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) শান্তির সুশীতল পথ বাতলিয়ে গেছেন। আমরা রবিউল আউয়াল মাসে যে ভাবে নবীকে স্মরণ করি, মাস শেষ হতে না হতেই সেই নবী (সাঃ) এর আদর্শ ও মহাব্বতের কথা ভুলে যাই। যা মুসলমানদের কাম্য নয়।
বর্তমান বিশ্বের নেতা নেত্রীরা যদি তার আদর্শ গ্রহণ করে তাহলে সমাজ থেকে সর্ব প্রকার দুঃখ, দুর্দশা ও অশান্তি দূর হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তি শৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থা। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তার আদর্শ আকঁরে ধরার তৌফিক দেন আমিন।
লেখক: ইসলামী কথা সাহিত্যিক, গবেষক ও কলামিষ্ট
mostakimbogra@gmail.com
01712-777058|
মন্তব্য করুন