অর্থ পাচারের ঘটনা একটি বড় অপরাধ। এ জন্য শাস্তির বিধান আছে, অর্থ পাচার বন্ধে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। তদুপরি বারবার অর্থ পাচারের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। ফলে অর্থ পাচারের ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না কেন, এ প্রশ্নকে সামনে রেখে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি বলেই প্রতীয়মান হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, বিগত হাসিনা সরকারের আমলে অর্থ পাচারে উদ্বিগ্ন সরকার। মুদ্রা পাচার শুধু একটি দেশের অর্থনীতিরই ক্ষতি করে না, দেশটির উন্নয়ন প্রচেষ্টাকেও ব্যাহত করে।
গত দেড় দশকে টাকা পাচারের স্বর্গরাজ্য ছিল বাংলাদেশ। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সুশাসনের অভাব আর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রশ্রয়ে এ দেশের টাকা খুব সহজেই পাচার হয়েছে ভিন দেশে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বলছে, এ সময়ে প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সরকারের অন্তত সাতটি নজরদারি সংস্থা থাকার পরও সবার নাকের ডগায় এই বিপুল অংকের টাকা চলে গেছে বিদেশে।
আর এই পাচারের প্রায় ৮০ শতাংশই হয়েছে বাণিজ্যের আড়ালে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত দুর্বল শাসন ব্যবস্থা, নজরদারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবসহ অন্তত এক ডজন কারণে টাকা পাচারের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। আশার কথা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই টাকা পাচার ঠেকানো এবং পাচার করা টাকা ফেরাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এরই মধ্যে টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত ও দুদকের বিগত বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনায় এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে গত সোমবার দুদকে বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) দুজন প্রতিনিধি। তাদের কাছে পাচারের টাকা ফেরাতে সহায়তা চেয়েছে দুদক। তথ্য-উপাত্ত থেকে আরো জানা যায়, পণ্য আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বড় অংকের মুদ্রা পাচার করা হয়।
কখনো আন্ডার ইনভয়েস কখনো বা ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে এই পাচার হয়ে থাকে। প্রবাসীদের বাড়তি টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে হুন্ডির মাধ্যমেও একটি বড় অঙ্কের টাকা পাচার হয়। দেশের গুটি কয়েক অসাধু শীর্ষ ব্যবসায়ী থেকে মাঝারি স্তরের ব্যবসায়ী-আমদানিকারকরাও এই পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কাষ্টমস, বন্দরসহ অনেক সংস্থার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদেরও যোগসাজস থাকার প্রমাণ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিনানশিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) তথ্য অনুসারে, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় পাচার করা টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলারে ১১৮ টাকা ধরে)।
এ হিসাবে গড়ে প্রতি বছর পাচার করা হয়েছে অন্তত এক লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা। দুদকের সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক জেলা জজ মো: মইদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিদেশ থেকে পাচার করা সম্পদ দেশে ফেরত আনতে চাইলে প্রথমেই দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এ ছাড়া অর্থ পাচার রোধে সরকারি সংস্থাগুলোকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্যে জোরালো উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
স্মর্তব্য, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের তালিকায় এর আগে শীর্ষে ছিলেন রাজনীতিবিদরা। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী রাজনীতিবিদদের ছাড়িয়ে গেছেন ব্যবসায়ীরা, যারা জনগণের অর্থে সরকারের দেওয়া প্রচুর সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এ দেশে ব্যবসা করেন। পাচারের তালিকায় এরপরই রয়েছেন দুর্নীতিবাজ একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা।
আমরা বলতে চাই, অর্থ পাচারকারীরা যাতে কোনোভাবে পার না পায়, সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়া দরকার, সেটি নিশ্চিত করতে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। তা না হলে নানা প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচারের ঘটনা বাড়তে থাকবে এমন আশঙ্কা থাকে-যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।