হুমায়ুন কবীর রুস্তম
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভর্তি যুদ্ধের মাধ্যমে বাছাইকৃত শিক্ষার্থীরা এখানে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। সেদিক থেকে বলতে গেলে দেশের প্রথম স্তরের মেধাবীদের নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার। কিন্তু সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তোফাজ্জল কান্ড মেধাবীদের নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তোফাজ্জলকে মোবাইল চুরির অপরাধে অভিযুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। এরপর হলের একটি রুমে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে নির্যাতন করা হয়। অতঃপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তোফাজ্জল। কেউ বলছে এটি ঠান্ডা মাথার খুন আবার কেউ বলছে ক্রুদ্ধ জনতার হাতে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। পরিকল্পিত কিংবা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যাই হোক না কেন শিক্ষার্থীদের এমন বিবেকহীন কর্মকান্ড সত্যিই নিন্দার দাবিদার।
অপরদিকে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটেছে এমন ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে একদল শিক্ষার্থী। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এই দুটি ঘটনায় যে কথাটি বেশি আলোচিত তা হলো ''মব জাস্টিস''।
মব অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। জাস্টিস অর্থ বিচার বা ন্যায়বিচার। অর্থাৎ উত্তাল জনতা যখন আইন বা আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে বিচারিক কর্মকান্ড ঘটায় তখন তাকে ‘মব জাস্টিস’ বলে। এ ধরনের ঘটনায় কেউ মারা গেলে তাকে লিঞ্চিং বলে। এর অর্থ বিচার বহির্ভূত হত্যা। আর এমন ঘটনায় আমজনতার প্রত্যক্ষ যুক্ততার কারণে খুনিদের শনাক্তকরণ কঠিন হয়ে পড়ে ফলে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা কিছুটা দুস্কর।
এমন ঘটনা সাধারণত সংগঠিত হয় যখন একটি দেশের বিচার ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে অর্থাৎ প্রশাসনের প্রতি জনগণের অনাস্থা, আইনপ্রণয়নের অভাব, উত্তাল রাজনীতি, অব্যবস্থাপনা, ক্ষোভ, সামাজিক বৈষম্য ইত্যাদি । এ সময় জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে উদগ্রীব হয়ে পড়ে ফলে দেখা দেয় মব জাস্টিস । মব জাস্টিস অনেক সময় সাধারণ জনগণের জন্য হুমকি হয়ে উঠে। প্রাণ যায় নিরীহ মানুষদের। তাই সুশীল সমাজের মতে, একটি দেশে মব জাস্টিস কোনো ভাবেই কাম্য নয়।
বর্তমানে দেশে মব জাস্টিস অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছে। বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারী কর্মকর্তাগণ পালিয়ে যায় ফলে সেই সকল জায়গায় শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তার মধ্যে পুলিশ বাহিনীর কর্মবিরতি বড় ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি করে। আর এ সময় আমজনতা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। যার প্রমাণ সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও আকারে রয়ে গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলেও আইন প্রশাসন এখনো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। যদিও তা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর এই দুর্বলতার ফলে উত্তাল জনতা যেখানেই অন্যায় দেখছে সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তারা অপরাধীদের আইনের হাতে তুলে না দিয়ে নিজেরাই বিচার এবং শাস্তি প্রদান করছে। যা থেকে জন্ম নিচ্ছে তোফাজ্জল হত্যার মতো দুঃখজনক ঘটনা।
মব জাস্টিসে যে শুধু অপরাধীরাই ভিকটিম হয় এমন নয়। অনেক সময় ভুল বুঝাবুঝির জন্য নিরীহ মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়। যার অন্যতম উদাহরণ রেনু বেগম। ২০১৯ সালে বাড্ডায় তসলিমা বেগম রেণু নামের এক মা’কে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়। যা দেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়। শুধু রেণু বেগম নয় ২০১১ সালের জুলাই মাসে আমিন বাজারে ‘ডাকাত’ সন্দেহে মেরে ফেলা হয় ৬ জন ছাত্রকে।
সম্প্রতি রাজশাহীতে, গত ৭ সেপ্টেম্বর আব্দুল্লাহ আল মাসুদ নামের এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে মারা হয়। ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে ৮০০ জনকে হত্যা করা হয়। এবং গত ছয় বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে আরও ২৮৬ জন। এর মধ্যে ২০২৪ সালে নির্বাচনের পর গত ৭ মাসে গণপিটুনিতে নিহত হন ৩২ জন।
মব জাস্টিস কখনোই সুষ্ঠু বিচারের প্রতিনিধিত্ব করে না। অনেক সময় পূর্ব ক্ষোভের প্রতিশোধ নিতে পরিকল্পিতভাবে মব জাস্টিস ঘটানো হয়। যা রয়ে যায় সাধারণ মানুষের চক্ষুর আড়ালে। শুধু তাই নয় অনেক সময় আমজনতা কোন কিছু না ভেবেই অন্যের শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে পিটাতে থাকে যা সত্যিই অবিচারের শামিল। সব থেকে বড় কথা মব জাস্টিস একটি দেশের বিচার বিভাগের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
তাই আমাদের উচিত এই অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা। এক্ষেত্রে প্রথমে কাজে লাগাতে হবে আমাদের বিবেককে। কোন অপরাধীকে ধরার পর তাকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করতে হবে। সেই সাথে দেশের আইন প্রশাসনকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে এবং এমন ঘটনা যেন না ঘটে সেদিকে নজর দিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো শক্তিশালী করতে হবে এবং দুর্নীতি দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই মব জাস্টিস রুখে দেওয়া সম্ভব। পরিশেষে বলতে চাই, মানুষ হয়ে মানবিকতার পরিচয় দিন। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া থেকে বিরত থাকুন। দেখবেন সুন্দর একটি সমাজের উদ্ভব ঘটবে।
লেখক : শিক্ষার্থী-গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
humayunkobir.rustom@gmail.com
01787838888
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।