দেশটা চলবে কীভাবে? কৃষি জমির মাটি চুরি হয়ে যাচ্ছে

রবিউল ইসলাম রবীন

প্রকাশিত: জানুয়ারী ২৫, ২০২৩, ০৫:৪৪ বিকাল
আপডেট: জানুয়ারী ২৫, ২০২৩, ০৫:৪৪ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

সরকারি গেজেটে প্রকাশিত মাটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাসকরণ ২০১৩ সালের ৫৯ নং আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করার উদ্দেশ্য কৃষি জমি হতে মাটি কাটা বা সংগ্রহ করে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। আরেক সরকারি আইনে বলা হচ্ছে আইন না জেনে যারা ঘর-বাড়ি ও বহুতল স্থাপনা নির্মাণ করছে, তাদের জানতে হবে ইচ্ছে হলেই কেউ নিজের জমির শ্রেণী পরিবর্তন করতে পারবে না।

আইনটা প্রায় সবাই জানে। তাও কেউ কথা রাখে না। ফসলি জমির উপরিভাগের টপ সয়েল উর্বর মাটি। মাটি কাটা চলছে। বিত্তবানরা কিনছে। কেউ কেউ এই মাটি নিয়ে ব্যবসা করছে। সরকারি কর্মকর্তারা কাক ডাকা ভোরে কোথাও কোথাও এসব মাটি ব্যবসায়ীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাদের জরিমানাও করছে। দেশের প্রায় সব স্থানে আমাদের সোনার জমি হারাচ্ছে। যে জমি আমাদের কৃষির প্রাণ।

তাহলে এইভাবে মাটি কাটার মহোৎসব চললে আগামী ৫০ বছর পর হয়ত কৃষি জমি বিলুপ্তির পথে যাবে। তাহলে দেশের মালিক যে কৃষক, তাঁদের কি হবে? জমির মাটি কেটে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। পাহাড় কাটছে দুর্বৃত্তরা। সরকারি গাছ কাটছে দুর্বৃত্তরা। হিংসার বশে কেউ কেউ কচি গাছ কাটছে কারো। পকেট কাটছে অহরহ কেউ। কাটার এক মহোৎসব চলছে। কে কত কাটতে পারে। কিন্তু বৃক্ষ রোপণের কি উৎসব হয়?

সরকারি কৃষি শুমারী সূত্র মতে, গত ১১ বছরে দেশে নিট আবাদি জমি প্রায় ৪ লাখ একর কমেছে। ২০০৮ সালে ফসলি জমির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার  হেক্টর, ২০১৯ সালের শুমারিতে দেখা যাচ্ছে নিট আবাদি জমির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার হেক্টর।  ১১ বছরে সারা দেশে নিট আবাদি জমি প্রায় ৪ লাখ ১৬ হাজার একর কমেছে। গত ৩৭ বছরে শুধু বাড়ি নির্মাণ হয়েছে ৬৫ হাজার একর জমিতে।

কৃষি জমিতে বসতবাড়ি হচ্ছে, পুকুর কাটা চলছে, পুকুর কেটে মাছের ফার্ম হচ্ছে। চোখের সামনেই হচ্ছে। একটি উপজেলায় একজন ইউএনও বা এসি ল্যান্ড থাকে। ভ্রাম্যমাণ আদালত তারাই করতে পারে। শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে এই দুষ্ট দমন করা সম্ভব?  জনপ্রতিনিধিরাও তো এসব বিষয়ে ভুমিকা রাখতে পারে। দেশটা তো সবার। সাধারণ মানুষ জেগে উঠা ছাড়া এসব ব্যধি মনে হয় দূর হবেনা।

কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভুমি ব্যবহার নিয়ে প্রথম আইনের খসড়া হয় ২০১১ সালে। এরপর ১০ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু চুড়ান্ত হয়নি কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভুমি ব্যবহার আইন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) চালের প্রাপ্যতা ও দামের অস্থিরতা নিয়ে একটি আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধারে কৃষি উপকরণ ক্রয় ও গ্রামের মজুরগার ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার কারণে দ্রুত ফসল ও জমি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা।

ইটভাটায় মাটি সরবরাহের কাজে নিয়োজিত ট্রাক্টর চলাচলের কারণে নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ, শহরের সড়কগুলি। জমির মাটির আবার দালাল আছে। সেই দালালরাই ট্রাক্টর ভাড়া করে। কোন রাস্তা কতটুকু ক্ষতি হলেই বা কার কি ? ভারি ট্রাক সবচেয়ে ক্ষতি করছে সড়কের। শব্দদূষণ আর বায়ুদুষণ তো আছেই।

কৃষি জমিতে পুকুর খনন বা মাটি ভরাটও অবৈধ। তারপরও কৃষি জমিতে পুকুর কেটে মানুষ মাছের ফার্ম বানাচ্ছে। এ সবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বলতে স্থানীয় ইউএনও মাঝে মাঝেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করছে। কিন্তু সমাজের রাজনীতিবিদসহ আমাদের কি এসব বিষয়ে কোন দায়িত্ব নেই?

আমি মনে করি একজন ওয়ার্ড কমিশনার বা একজন ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্যরা জানে কারা এই সর্বনাশগুলি করছে। সরকার এই জনপ্রতিনিধিদের এই বিষয়ে কাজে লাগাতে পারে। এরপর আসুন অবৈধভাবে গাছকাটা বিষয়ে। সব ধরনের বন সংরক্ষণের বিধান রেখে ’ বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন আইন ২০২২’-এর আইন অনুযায়ী ব্যক্তি মালিকানায় লাগানো বড় গাছ কাটতেও সরকারের অনুমতি লাগবে। এই আইনে বলা আছে, মানুষ যাঁরা সাধারণ বাগান করবে বা স্থায়ী যে গাছ লাগাবে,সেগুলিও তারা তাদের ইচ্ছা মতো কাটতে পারবে না।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশে এরকম আইন আছে। সরকারি, বেসরকারী, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব জায়গায় অবস্থিত ঝরে পড়া বা কোন কারণে পুরানো গাছ কাটার প্রয়োজন হলে, সে গাছ কাটা ও নিলামে বিক্রয় করার লক্ষ্যে কমিটি গঠন করে গাছ বিক্রি করতে হবে। সেই কমিটিতে উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও, শিক্ষা প্রকৌশলী অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, বিভাগীয় বন কর্মকর্তার প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান সেই কমিটিতে থাকবে। কিন্তু কতজন এই আইন মানেন ? আর এসব দেখভাল করার বা মনিটরিং করাটা হয় না। আর সর্ষের ভেতরে যদি ভূত থাকে, তাহলে সমস্যা।

ওদিকে অবাধে পাহাড় না কাটার বিধানও আছে। কিন্তু পাহাড় থেকে মাটি চুরি হচ্ছে। মানুষ মানুষের পকেট কাটছে। সড়ক,মহাসড়কের পাশে অবৈধভাবে মানুষ জমি কাটছে, দখল করছে। মানুষের দেহ মানুষ কাটছে। মানুষের মন মানুষ কাটছে। কাটাকাটি সর্বত্র। দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। কে রোধ করবে? মনে হচ্ছে কোথাও কেউ নেই। মনে হচ্ছে, চুরি করে কেউ ১৭ কোটি মানুষকে নিয়ে গেছে অন্য গ্রহে। তাই দরকার জোরালো মনিটরিং আর আইনের যথাযথ প্রয়োগ। একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল, সফল বাংলাদেশকে মানুষ দেখতে চায়।

লেখক : সহকারি অধ্যাপক-কলামিস্ট                                                                                                                   

[email protected]

01828-114376 

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়