পানির দেশ বাংলাদেশে বিশুদ্ধ পানির সংকট ঘোরতর হয়ে উঠছে। ফসলের খেতে পানি সেচ সহ নানা প্রয়োজনে ভূ-গর্ভস্থ পানির ঢালাও ব্যবহারে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের বহু এলাকায় কয়েক মাইল দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। দেশের উপকূলভাগের প্রতিটি এলাকায় লবণাক্ততার কারণে পানযোগ্য পানির অভাব প্রকট।
শুস্ক মৌসুমের শুরুতেই বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েছে। জলবায়ুর প্রভাবে সবখানেই লবণাক্ত পানির আগ্রাসন। উপকূলের মানুষকে ১০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে কলসি ভরে পানি আনতে হচ্ছে। পত্র-পত্রিকার খবরে প্রকাশ উপকূলীয় এলাকায় এক কলসি পানির দাম ৫০ থেকে ৮০ টাকা। উপকূলের নারীদের পানির সন্ধানে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘপথ।
বিশুদ্ধ যাচাই-বাছাই তো দূরের কথা, কোনো মতে খাওয়া যায় এমন খাবার পানি জোগাড় করতেই উপকূলের নারীদের দিন চলে যায়। দেশের উজানের বরেন্দ্র অঞ্চলের সুপেয় খাবার পানির এমন সংকট বাড়ছে। দেশের অন্যান্য এলাকার মতো ঢাকাতেও ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। ঢাকা মহানগরীতে ১৯৭০ সালে ৪৯টি গভীর নলকূপ ছিল। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষিত পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় ওয়াসা সুপেয় পানির চাহিদার শতকরা ৭৮ ভাগ ৯০০টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে গর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করছে।
নদীর পানি দূষিত হওয়ার ফলে ওয়াসা এত সব নলকূপ বসিয়েছে। অথচ ওয়াসাকে নদীর পানি দূষণ রোধে পয়:বর্জ্য পরিশোধনে কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না। এদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানি অধিক উত্তোলনের ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ১০ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। শিল্প কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। ফলে নদী দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত পানি উজানে প্রবাহিত হচ্ছে।
নদী দূষণমুক্ত ও পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করা না হলে এবং বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে নদীর পানির অভাবে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। পানির অপর নাম জীবন। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচসহ সব কাজে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। সুপেয় ও চাষাবাদের পানির চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যবহার হয় ভূ-গর্ভস্থ স্তর থেকে।
অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকার ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আশংকাজনক হারে নামছে নিচের দিকে। ওয়াসা সুপেয় পানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ভূ-গর্ভস্থ স্তর থেকে পানি উত্তোলনে বাধ্য হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। রাজধানীর নদীগুলোর পানি মাত্রাতিরিক্ত দূষিত হয়ে পড়ায় ও পরিশোধন করে ব্যবহার করাও কঠিন হয়ে পড়ছে।
এ অবস্থায় ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর যে বাড়তি চাপ পড়ছে তা অশনিসংকেত বলে বিবেচিত হচ্ছে। রাজধানীর পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাওয়ায় বিপদ সৃষ্টি হচ্ছে অন্য দিক থেকেও। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগের দূষিত পানি ভূ-গর্ভের শূন্য স্থানে প্রবেশ করে নাগরিক জীবনের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। এ ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারকারীরা নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছে।
এ ছাড়াও বাংলাদেশ যে পানি সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে তার প্রধান কারণ উজানে পানি প্রত্যাহারের ঘটনা। নদ-নদীর ধারণ ক্ষমতা হ্রাসও এ বিপদের জন্য দায়ী। নদী দূষণ অবস্থাকে ভয়াবহভাবে বিপজ্জনক করে তুলছে। অস্তিত্বের স্বার্থে উজানে পানি প্রত্যাহার রোধে সরকারকে সক্রিয় হতে হবে। নদ-নদীর ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো ও দূষণ বন্ধে নিতে হবে পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে কোথাও হেলাফেলা কাম্য নয়। বিশুদ্ধ পানি পান মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার পূরণে সরকার যত্নবান হবে এমনটিই প্রত্যাশিত।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।