মোছা: তাসলিমা পারভীন
যখন ছোট ছিলাম স্কুলে পড়তাম বাবা, মা কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন তখন গুরুজনেরা নাম জানার পাশাপাশি একটি প্রশ্ন করতেন বড় হয়ে কি হতে চাও? অনেক ভেবে উত্তর করিনি। তখন ছোট ছিলাম সমাজে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিকে শিক্ষক মনে করতাম। তাই উত্তর করলাম শিক্ষক হতে চাই।
শিক্ষক কেন? শিক্ষক জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। মুরব্বি মুচকি হেসে উত্তর করলেন অনেক সম্মান, সালাম, খ্যাতি পাবে কিন্তু নুন আনতে পান্তা ফুরাবে তার চেয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হলে ভাল করবে। দুই হাত ভর্তি টাকা কামাবে, বাড়ি করবে, গাড়ি করবে সাথে মানব সেবাও করতে পারবে। আজ আমি শিক্ষক। গর্বিত শিক্ষক। আমার সম্মান আছে, গৌরব, সুনাম আছে। কেউ পরিচয় শুনে ম্যাডাম বলে সংবর্ধনা করেন। তারপর ঘন্টা কয়েক বসিয়ে রেখে জানতে চান এবার বলুন ম্যাডাম কি করতে পারি?
আজ ওই মুরব্বির কথা খুব মনে পড়ছে উনি বলেছিলেন সমাজে তোমার অবস্থান নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো হবে। তার বাস্তব প্রমাণ শেয়ার করছি : ত্রিশটা দিন যখন পার করে পারিশ্রমিক পেয়েছিলাম ছোট্ট্র একটি নোট বুক হাতে বাসায় ফিরেছিলাম। প্রতিটি খরচ লিখে লিখে পনেরো বা বিশ দিন যখন পার করলাম তখন শুরু হল আসল মজা। আরও দশদিন বাকি আছে অথচ হিসেবের খাতায় আয়-ব্যায়=শূন্য। ভাগ্যিস কোন অসুখ করেনি, ঔষধ কিনতে হয়নি অথবা পরিবারের সদস্যদের কোন ডাক্তার দেখাতে ভিজিট গুণতে হয়নি। দুই হাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুকরিয়া জানিয়েছিলাম।
অতপর আবার দুশ্চিন্তা চোখে মুখে আছড়ে পড়তে লাগল কারণ আমি একজন শিক্ষক। সমাজে আমার অনেক সম্মান কিভাবে মানুষের কাছে হাত পাতবো ? ধার দেনা কিভাবে করবো? তাহলে উপায়? বাকি দশটি দিন কিভাবে পার করবো? এ প্রশ্ন আমার মত শত শত শিক্ষকের যারা জাতির মেরুদন্ড। রিক্ত, ভারাক্রান্ত মনে নিজের বাসায় ফিরে দিনরাত হিসাব কষে মাস পার করেন। পরিবারের সদস্যদের শান্ত গলায় শান্ত্বনার বাণি পান করিয়ে নিজেই বিষের যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকেন কারণ জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বি কিভাবে নাগাল মিলবে? কিভাবে পরিবারের সন্তানদের মানুষ করবে? কি তাদের ভবিষ্যৎ? এ বাজারে চাকরি পাওয়া সোনার হরিণ পাওয়ার মত ভাগ্য। মামা, চাচা, খালু যাদের নেই তাদের কপালে সোনার হরিণ দূরে থাক ব্রয়লার মুরগী জোটাও দুষ্কর হয়ে পড়ে। আমার মামা, চাচা, খালু কেউ নেই তাহলে প্রশ্ন চাকরি পেলাম কি করে? মজার কিছু ঘটনা শেয়ার করছি যেখান হতে বুঝবেন সোনার হরিণ কিভাবে আমার কাছে ধরা দিল:
এস এস সি পরীক্ষা দেয়ার পর রেজাল্টের অপেক্ষায় না থেকে একটি নতুন কেজি স্কুলে জয়েন করলাম। যদিও অভিজ্ঞতা অর্জন করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য তার পরেও স্কুল কমিটি বলেছিলেন সম্মানি দিতে পারবেন না, যদি শিক্ষার্থী আশানুরূপ ভর্তি হয় তবে যাতায়াতের ভাড়া দিবেন। আমি পরামর্শ করলাম এলাকায় বাড়ি বাড়ি যেয়ে শিক্ষার্থী কালেক্ট করতে। আমিসহ সকল শিক্ষক এভাবে ১৫ দিন এলাকাসহ, এলাকার বাহিরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থী আনলাম। কর্তৃপক্ষ খুশি হয়ে আমাকে ১০০০ টাকা বেতন নির্ধারণ করে দিলেন। এভাবে ৩ মাস চাকরি করলাম। রেজাল্ট হবার পর এইচএসসিতে ভর্তি হলাম।
পুনরায় পরীক্ষা দিয়ে আবার স্কুলে জয়েন করলাম। এতদিনে স্কুলটি বেশ ভালভাবে হাঁটছে। এভাবে রেজাল্ট হবার পর বিএসসিতে ভর্তি হলাম। পাশাপাশি বি এড, এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ করতে লাগলাম। কম্পিউটার কোর্স শেষে বিএসসি ফাইনাল দিয়ে একটি কলেজে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে জয়েন করে, এলএলবি তে ভর্তি হলাম। রেজাল্ট হবার পর বিয়ে হল। কলেজে আর জয়েন না করে বাড়ির পাশে কেজি স্কুলে জয়েন করলাম। আমার গুড পারফমেন্স দেখে প্রিন্সিপাল স্যার উনার বন্ধুর স্কুলে জয়েন করবার পরামর্শ করলেন কারণ ওটা প্রতিষ্ঠিত, বেতন বেশি এবং সময়ে স্থায়ী, সরকারি হবার সম্ভাবনা আছে। উনার বন্ধু ইন্টারভিউ নিলেন, ভাল রেজাল্ট করলাম কিন্তু জানালেন কমিটিকে মাত্র ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে। আমি টাকার বিনিময়ে চাকরি করতে নাকোচ করলাম।
তার বছর খানেকের মাথায় স্কুলটি সরকারি হয়েছে। মাস কয়েক পর এক আগুন্তুক মেয়ে বাসায় আসল। খুব করে অনুরোধ করল শহরে সরকারি স্কুলে কম্পিউটার পোষ্টে লোক নিবে কিন্তু ক্যান্ডিডেট স্বল্পতা থাকায় উনি নিরুপায়। আমি নই উনি আমার ব্যাংক ড্রাফ্ট সহ যাবতীয় কাজ করে আবেদন করালেন। পরীক্ষার দিনে উনি আমাকে সাথে নিয়ে হাজির হলেন আর অনুরোধ করলেন শুধু অংশগ্রহণ করতে, খাতায় কিছু না লিখতে। কারণ উনি ৩ লক্ষ টাকা কমিটিকে জমা করেছেন বাকি ২ লক্ষ টাকা দিবেন চাকরি হলে। আমি ভাবলাম সাদা খাতা কিভাবে জমা করব তার চেয়ে ২/৩টা উত্তর লিখলাম। ঘন্টা খানেক পর ফলাফল জানালো আমি টিকেছি। এবার শুরু হলো কান্নার রোল। হাতে, পায়ে ধরে অনুরোধ করতে লাগল আমি যেন চাকরিটা না করি কারণ উনি জমি বিক্রি করে টাকা জমা করেছেন, ফেরত পাবে না। আমি ভাইভা বোর্ডে জানালাম চাকরি করতে চাই না, শুধু মেধা যাচাই করতে এসেছি। মাস খানেক পর একটি সুনামধন্য প্রতিষ্ঠিত স্কুলে পত্রিকায় সার্কুলার দেখে দরখাস্ত দিতে গেলাম।
এক পরিচিত স্যার আমাকে জানালেন নতুন এক স্কুল খুলেছে, তুই ওখানে দরখাস্ত দে। স্কুলটি ভবিষ্যতে সুনাম পাবে। কথা যা কাজও তাই পরের দিনে শেষ ডেটে দরখাস্ত ফেললাম। ৩ দিন পরে ফোন আসল আমি প্রাথমিক নির্বাচনে সিলেক্ট হয়েছি। তারপর দফায় দফায় ধৈর্য্যরে সাথে ৩-৪দিন ইন্টারভিউ দিলাম। কারণ সবাই বলাবলি, অনেকে সরাসরি বলছিলো এখানে লোক নেয়া হয়েছে, এগুলো আই ওয়াস। আমি সবার কথাকে উপেক্ষা করে নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে শেষ পর্যন্ত জয়েন করলাম। এতকিছু শেয়ার করবার কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত আমি আমার দেখা স্বপ্ন পথে হেঁটেছি, ধৈর্য্য সহকারে পরিশ্রম করেছি, কাঙ্খিত ফলাফল পেতে অন্যের কথায় কান দেইনি। দ্বিতীয়ত নিজের যোগ্যতার ওপরে ভরসা করেছি। তৃতীয়ত মামা, চাচা, খালুর ভরসা নয়, কোন ঘুষকে প্রশ্রয় দেইনি।
সাহসের সাথে সর্বদা শিক্ষা গ্রহণ করেছি কারণ অবসান রেখে বিভিন্ন ডিগ্রি গ্রহণ করেছি যেন বিফলে অন্য প্রফেশন বেছে নিতে পারি। কাঙ্খিত সফলতার দ্বার প্রান্তে পৌছাতে না পারলে বেকার জীবন আমাকে যেন কষ্ট না দিতে পারে। সমাজ, সংসার তথা দেশে বোঝা হয়ে বেঁচে থাকতে না হয়। দেশ উন্নয়নে আমিও সমান সামিল হতে পারি। দেশ তো ঠিকই উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু শিক্ষকদের হিসাবের টালি খাতা কবে বন্ধ হবে ? দেশের মেধাবী শিক্ষিত বেকারদের কষ্টের লাঘব কবে ঘটবে ? মামা, চাচা, খালুদের বদৌলতে চাকরি প্রাপ্তদের কোটা কবে বন্ধ হবে? জমি জমা বিক্রি করে নিয়োগ প্রাপ্ত কমিটি সদস্যদের হাতে লাখ লাখ টাকা তুলে দিয়ে হাজার হাজার পরিবার নি:স্ব হয়ে চোখের জলে পথে বসা হতে কবে মুক্তি পাবে ? এ প্রশ্ন রাখলাম বিবেকবান প্রতিটি মানুষের কাছে।
লেখক : শিক্ষক-প্রাবন্ধিক
০১৭১৭-০১৬৮০৮
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।