এম এ বাসেত
ডিজিট শব্দের অর্থ সংখ্যা। ডিজিট থেকে ডিজিটাল শব্দের উৎপত্তি। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। কয়েক বছর আগে ভারত এবং মায়ানমার থেকে পাওয়া প্রায় ২৮ হাজার ৪ শত ৬৭ বর্গ কিলোমিটার ও ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমা বর্তমানে এদেশের মোট প্রায় ২ লক্ষ ৪৭ হাজার ৬৭৭ বর্গ কিলোমিটার। এই ছোট একটি দেশ প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে।
স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দেশকে পরাশক্তি থেকে মুক্ত করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমতা, সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার, ঘুষ-দুর্নীতি মানুষে রক্ষার জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। এদেশকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট মধ্য সারির সশস্ত্র অফিসারদের অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রে জাতীয় চারনেতা সহ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মম নারকীয় হত্যাকান্ড সংঘটিত করে এদেশকে চিরতরে দমিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত জাতির ইতিহাসে জলজ্যান্ত উদহারণ। যতসব ষড়যন্ত্রকে পিছনে ফেলে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে দূর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ ডিজিটালের দ্বোর গোড়ায় পৌছে গেছে।
এখন ডিজিটাল থেকে উন্নত উচ্চ উন্নয়নশীল স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করছে। দেশে নিত্যপণ্যের দাম প্রতিনিয়ত নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। শ্রমিক, গরীব সাধারণ ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। এজন্য সরকারের উচিত বাজার মনিটরিং বাড়িয়ে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরলে উন্নয়নের স্বার্থকতা জনমুখে সুনাম ছড়াবে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরের হাইট-টেক পার্ক সিটি বিশ্বের ৭ম বৃহত্তম জাতীয় ডাটা সেন্টার। গত ২৮ নভেম্বর ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড’ নামে পরিচালিত হচ্ছে।
এছাড়া নেটওয়ার্কের আওতা বহির্ভুত দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকা সমূহের অবশিষ্ট ৬১৭টি ইউনিয়নে কানেক্টিভিটি প্রদানের লক্ষ্যে ‘‘কানেক্টেড বাংলাদেশ’’ শীর্ষক প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজও চলমান। এছাড়া পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, পরমাণু শক্তিধর দেশে প্রবেশ সহ বড় বড় মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে সরকার ডেল্টাপ্লান হাতে নিয়েছে। এই মিশন-ভীশনকে সামনে রেখে বর্তমান সরকার আগামী দিনে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গিকার করছে। বাংলাদেশ দিন দিন ডিজিটাল অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির দিকে ঈর্ষনীয়ভাবে অগ্রসর হয়েছে।
২০২১-২২ অর্থ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা যথাক্রমে ১৮.১৫ কোটি ও ১২.২৮ কোটিতে। দেশের সর্বমোট ইন্টারনেট চাহিদার প্রায় ৬০% ব্যান্ডউইথ বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি (বিএসসিসিএল) বর্তমানে এককভাবে ২০৬০ (জিবিপিএস) গিগাবাইট পার সেকেন্ড সরবরাহ করছে। দেশের ১৮ হাজার ৫০০ টি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ও ৩ হাজার ৮০০ ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক ক্যাবল স্থাপনের মাধ্যমে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি প্রদান করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের অগ্রগতি আমাদের জন্য প্রশংসনীয়।
দেশে বেকার সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ ৩০ হাজার। সম্প্রতি শিশু-কিশোরদের প্রযুক্তিতে আসক্তি আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে। দেশে ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সসীমায় মোবাইল ব্যবহারকারীর হার ৫৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ১৮ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সীদের মধ্যে ৭২ দশমিক ৩১ শতাংশ মানুষের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন রয়েছে। মোবাইল ব্যবহারে লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ পুরুষ ও ৪৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ নারী রয়েছে। ১৮ বছর ও তদুর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে ৮৬ দশমিক ৭২ শতাংশ পুরুষের ও ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ নারীর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন রয়েছে।
বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে দুই শ্রেণির বয়সীদের মধ্যে নিজের ব্যবহারের মোবাইল ফোন রয়েছে; সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে এবং সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে। ২০২২ সালের বিগত তিন মাসে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে মোট ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং ১৮ বছর থেকে বেশি বয়সীদের মধ্যে ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ জনসংখ্যা ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে। বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে পরিলক্ষিত ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে এমন জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে এবং সবচেয়ে কম রংপুর বিভাগে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো আয়োজিত জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারে উদীয়মান শিশু-কিশোর এবং যুবসমাজ যেনো ধ্বংসের মুখে ধাপিত না হয়; সেদিকে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি দিতে হবে। এ বিপুলসংখ্যক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারীকে কর্মসংস্থান আয়-বৃদ্ধিমূলক কাজে লাগাতে হবে। তবে প্রত্যেক বেকার যুবক ডিজিটালের ডিজিটে পরিণত হবে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অসচেতনভাবে ক্রমশ মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারে আসক্তি বাড়ছে শিশু ও কিশোর- কিশোরীদের।
শহরের সাথে পাল্লা দিয়ে এখন গ্রামাঞ্চলেও স্মার্ট ফোনে আসক্তির হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। মোবাইল আসক্তির কারণে শিশুদের আচরণে দেখা দিচ্ছে নানা নেতিবাচক পরিবর্তন। শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মূলত শিশুদের ঘরে রাখতেই অভিভাবকরা বাচ্চাদের গেমস ও কার্টুন দেখে সময় কাটানোর জন্য স্মার্টফোন ধরিয়ে দিচ্ছেন।
ফোন ব্যবহারে ক্ষতির দিক জেনেও সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য ফোনই একমাত্র মাধ্যম বলে বেছে নিয়েছেন অনেক অভিভাবকরা।এর ফলে শিশু মেধা শূন্য হয়ে পড়ছে। গ্রাম পর্যায়ের শিশু-কিশোরদের মধ্যে টিকটক আর লাইকি নিয়ে উন্মাদনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এভাবেই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে তাদের। উঠতি বয়সে বখাটেপনা, দাদাগিরির মনোভাব নিয়ে নানান অনৈতিক কাজও করে বেড়াচ্ছে তারা। সংঘটিত হচ্ছে কিশোর অপরাধ।
এই গ্রুপের সদস্যরা বড়দের সঙ্গে বেয়াদবি, শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করতেও দ্বিধা করে না। আধিপত্য নিয়েও পরস্পরকে বিরোধে জড়াতে দেখা যায়।ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় ইন্টারনেটভিত্তিক নানা গেমস নিয়ে মেতে থাকে কিশোরদের দল। ফোনে টাকা বাজি ধরে লুডু খেলে। এছাড়া ফোনসেট এবং ইন্টারনেট হাতের মুঠোয় থাকায় সহজেই পর্নো ভিডিওসহ অশ্লীল ও অনৈতিক ভিডিও দেখার সুযোগ অনায়াসেই পেয়ে যাচ্ছে অপরিণত বয়সে। আর এসব শিশু-কিশোরই একটু বড় হলে জড়িয়ে যাচ্ছে নানা অপকর্মে। দলবেঁধে আড্ডা দেওয়া, মাদকদ্রব্য গ্রহণ, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে তারা।
এসব কাজকে স্মার্টনেসও মনে করে তারা।পরিবারের অসচেতনতার কারণেই কিশোররা বখাটে হয়ে যাচ্ছে। লেখাপড়া থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে।মূলত মোবাইল ফোনের অপব্যবহারের ফলেই উঠতি বয়সীদের অনৈতিক কর্মকান্ডের সূচনা। পরবর্তীতে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক, খুন, ইভটিজিংসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে।
স্মার্টফোনের নেশা শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শুধুমাত্র মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব নয়, শরীরেও মোবাইলের খারাপ প্রভাব পডবে। কারণ বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করা, খেলাধুলা, বই পড়া প্রভৃতির মাধ্যমে ধীর গতিতে আমাদের কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে। কিন্তু মোবাইলে খেলা, ভিডিও দেখার সময় অতি সত্বর শিশুমনে আনন্দ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হলেও কল্পনাশক্তি হ্রাস পাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের প্রতি ঘরে শিশুদের আরও সময় দিতে হবে। শিশু-কিশোর বয়সে হাতে মোবাইল ফোন দিয়ে অনেকটাই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। শিশু-কিশোরদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার যতটা সম্ভব দূরে রাখাই ভালো। এগুলো তাদের কল্পনাশক্তিকে সীমিত করে ফেলে। মোবাইলের প্রতি আসক্তি শিশু কিশোরদের সামাজিক দক্ষতা নষ্টসহ নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করে।
দীর্ঘ সময় মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখার ফলে চোখের সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। শিশুদের পারিবারিক ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ব্যাহত করে। টিভি, মোবাইল গেম বা যে কোনও ধরনের ভার্চুয়াল এন্টারটেনমেন্ট দেখার ফলে মস্তিষ্কের কোষ থেকেএক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার (ডোপামিন) ক্ষরণ হয়। এই ডোপামিনের ক্ষরণ মনে এক ভালো লাগার অনুভূতি সঞ্চার করে। ফলে অতি সহজেই এই ধরনের এন্টারটেনমেন্ট মিডিয়ামগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। জীবনের আনন্দ খুঁজে পেতে স্মার্টফোনকে সঙ্গী করে।
আমরা জানি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের স্মার্টফোনে হাতেখড়ি হয় অভিভাবকদের হাতেই। কিন্তু চাইলে অভিভাবকরাই পারেন সন্তানকে মোবাইলের আসক্তি থেকে অন্য জগতে ভুলিয়ে রাখতে। সাধারণত বাবা-মা যা করবেন সেটা দেখেই শিশু শিখবে। স্মার্টফোন ছাড়াও দুনিয়াতে আনন্দের আরও অনেক কিছু রয়েছে। বাচ্চার চোখে চোখ রেখে কথা বলা।
শিশু-কিশোরের ভিতরের সুপ্ত প্রতিভা ও ইচ্ছাগুলোকে শনাক্ত করে সেদিকে ঝোঁক বাড়ানো সম্ভব। বিকল্প ও আকর্ষণীয় জিনিসের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে পারলে শিশুর মুঠোফোনের প্রতি আসক্তি কমবে। যেমন, ছবি আঁকা, গান গাওয়া বা কোনও বাদ্যযন্ত্রের প্রতি খুদের কৌতূহল থাকলে সেই আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিত দিনের কম পক্ষে দুই ঘন্টার বেশি মোবাইল ব্যবহার করতে না দেওয়া।
বাড়ির আবহে পড়াশোনা-খেলাধুলার পরিবেশ থাকা অত্যন্ত জরুরি। রাতে ঘুমানোর আগের একঘন্টা ও সকালে ঘুম ভাঙার পর প্রথম এক থেকে দুই ঘন্টা শিশুটির ফোন ব্যবহার নিষেধ রাখতে হবে। এই নিয়ম বাবা-মায়ের জন্যও প্রযোজ্য হলে ভাল। উল্লেখযোগ্য, সপ্তাহে একটি দিন বাড়ির প্রত্যেক সদস্যের জন্য একটি স্মার্টফোনবিহীন দিন রাখতে হবে, সেদিন প্রত্যেক সদস্যের ছুটির পর শিশুটির সঙ্গে সময় কাটানো দরকার। মুঠোফোনের বাইরের পৃথিবীর সংস্পর্শে রাখা বর্তমান প্রজন্মের অভিভাবকদের মূল দায়িত্ব।
শিশুর এগিয়ে চলার স্বাচ্ছন্দ গতির উপর সুষ্ঠু বিকাশ নির্ভর করে। যার পরিকল্পিত রূপ দেওয়ার কারিগর হবে বাবা-মা। এ জন্য শিশুদের মোবাইল ফোন থেকে দূরে রাখতে হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশে তাদের পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে হবে।তা না হলে আগামী দিনে পরিবার ও দেশের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক : সাহিত্যিক ও আইটি উদ্যোক্তা।
০১৭১৮-২৮১৩৬৭
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।