সাম্যের কবি নজরুল

আরিফ আনজুম

প্রকাশিত: মে ২৫, ২০২৩, ০২:২৯ রাত
আপডেট: মে ২৫, ২০২৩, ০২:২৯ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

যিনি আপন মহিমায় ও স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি অনুভবের কবি, দেশ প্রেমের কবি, হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয় সাধনের কবি, বিদ্রোহী কবি হিসাবে বাঙালির মনে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে মে (বাংলায় ১১ ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে এক দুঃস্থ মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কাজী ফকির আহম্মদ, মাতা জাহেদা খাতুন। শৈশব থেকেই তিনি দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করতে থাকেন।

পিতৃহীন নজরুল চা দোকানে কাজের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে কাজ করতে করতে তিনি নাচগানের ‘লেটোদল’-এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। চা দোকানের কাজ ছেড়ে তিনি লেটো দলে সঙ্গীতকার হিসাবে যোগদান করেন। দ্রুত তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

কোন বন্ধন তাঁকে বেশি দিন আঁটকে রাখতে পারেনি। শিগগিরই লেটোদলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সময়টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিক। একজন সাধারণ সৈনিক হিসাবে ৪৯নং বেঙ্গল ব্যাটালিয়ান যোগদান করেন।

 

পাশাপাশি চলতে থাকে লেখালেখির কাজ। ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে ‘মোসলেম ভারত’-এ প্রকাশিত হয় তাঁর যুগান্তকারী কাব্য ‘বিদ্রোহী’, যা তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। এ কবিতার মধ্যে প্রতিটি গুমরে মরা বাঙালি তরুণ-তরুণী প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেল, খুঁজে পেল বিদ্রোহের নতুন ঠিকানা - “যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত-আমি সেই দিন হব শান্ত।”/সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষে গর্জে উঠেছিল বাংলা মায়ের দামাল ছেলের কলম-/“কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল, কররে লোপাট/রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণবেদী।”

লক্ষ লক্ষ মুক্তিকামী তরুণ তরুণীদের মনে উৎসাহ-উদ্দীপনার অপ্রতিরোধ্য জোয়ার এনেছিল। আকাশে বাতাসে বিদ্রোহের ঝড়, কবি উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দিলেন - “নাচে ওই কালবোশেখী, কাটাবি কাল বসে কি?”
এই সময় তিনি ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়েন। ব্রিটিশ বিরোধী, বিদ্রোহ প্রচারকের তকমা লাগিয়ে তাঁর ‘অগ্নিবীণা’ ও ‘বিষের বাঁশি’ বাজেয়াপ্ত করেন এবং কবিকে কারারুদ্ধ করেন।

 

দলে দলে তরুণরা শিকল ভাঙার গান গেয়ে স্বেচ্ছায় কারাগারে বন্দী হতে থাকেন - “এই শিকলপরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল।/এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল।” দেশমাতার সাথে দেশবাসীর প্রতিও তাঁর প্রগাঢ় ভালোবাসা ছিল। উদাত্ত কণ্ঠে তিনি বলেছেন-/“মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।”

ইংরেজ শাসকরা গোপনে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে ভেদমন্ত্র প্রচার করেছিলেন তাতে আসল সত্যকে চেপে রেখে মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশের পথ বন্ধ করে ভেদাভেদ বাড়াতে মনগড়া শাস্ত্র রচনা করেছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি। তাঁর প্রতিবাদী কলম গর্জে উঠল- 
“জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছ জুয়া!/ছুঁলেই তোর জাত যাবে?

 

জাত ছেলের হাতে নয়তো মোয়া।”/এই সত্য উপলব্ধি করেই মোল্লা-পুরোহিতদের মুখের সামনে তিনি বলতে পেরেছিলেন -“পুঁথির বিধান যাক পুড়ে তোর বিধির বিধান সত্য হোক।”
সর্বপ্রকার ভেদ বুদ্ধি আর সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি মানুষের জয়গান গেয়েছেন। তাঁর সোনার কলমে বলিষ্ঠ লেখনীতে দীপ্তকন্ঠে ঘোষিত হল- “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/মুসলিম তার নয়ন মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।” শুধু ভেদাভেদ নয়, কুলিদের প্রতি অত্যাচারের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিল তাঁর কলম।

তিনি লিখলেন -

“বেতন দিয়াছ? চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!/কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোড় পেলি বল?”
ভক্তিগানেও তিনি সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল-
‘শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম’, ‘বল্ রে জবা বল্ কোন সাধনায় পেলি রে তুই শ্যামা মায়ের চরণ তল’, ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা রে আলোর নাচন’, ইত্যাদি। তিনি নিজেকে “মরকবি” বলে উল্লেখ করেছেন। আপন ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তিনি সদা সচেতন ছিলেন। যুগস্রষ্টা কবি না হলে প্রথম সারির কবি হওয়া যায় না- একথা তিনি মনে প্রাণে মানতেন।

১৯৪২ সালে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বিদ্রোহী কবির কন্ঠ ও লেখনী স্তব্ধ হয়ে গেল। এই নিদারুণ ও অসহনীয় অবস্থায় দীর্ঘ ৩৪ বছর ঢাকায় কাটিয়ে ১৯৭৬ সালের ২৯ শে আগষ্ট বাংলা মায়ের দামাল ছেলে মাটি মায়ের কোলে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়েন।


লেখক : সাহিত্যকর্মী ও শিক্ষক

০১৭৭১-৩৭৭৩৫৯

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়