কাঁকড়া বিপ্লবের পথে বাংলাদেশ
বাংলায় ‘কাঁকড়াবাজী’ বলে একটা কথা আছে। কথাটার মানে হলো যে সবদিকেই যায়। সবদিকেই যাওয়া মানে সুবিধাবাদী। শব্দবন্ধটি এসেছে কাঁকড়ার সবদিকে হেঁটে যাওয়ার বা দৌড়ানোর ক্ষমতা থেকে। এ এক অদ্ভুত ক্ষমতা। যদিও আমাদের সমাজে কাঁকড়াবাজীকে একটি নেতিবাচক উপমা হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। সমাজে এ ধরনের লোকের অভাব নেই। যা হোক আমাদের প্রসঙ্গ কাঁকড়াবাজী নিয়ে নয়। কাঁকড়ার বহুমুখী কারবার ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা এবং এর রপ্তানিমূল্য নিয়ে।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য অফিস সূত্র থেকে জানা যায় গত অর্থবছরে ২০২২-২৩ খুলনা অঞ্চল থেকেই ৬২২ দশমিক ০৫ টন কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে। যার রপ্তানি মূল্য ৮৬ লক্ষ ৯৮৮ ডলার। এবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক অন্যান্য অর্থ বছরের দিকে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে নরম কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে ৫৬৭ টন, যার রপ্তানি মূল্য ৬৯ লক্ষ ৩৫ হাজার ডলার। ২০২০-২১এ রপ্তানি হয়েছে ৫১৮ টন যার রপ্তানি মূল্য ৬৯ লক্ষ ৫১ হাজার ডলার। ২০২১-২২ এ রপ্তানি হয় ৮০২ টন যার রপ্তানি মূল্য ১ কোটি ১২৬ লাখ ৫১ হাজার ডলার। পল্লী সহায়ক ফাউন্ডেশন জানাচ্ছে দেশে তিন লাখেরও বেশি মানুষ কাঁকড়া চাষ ও বাজারজাতকরণের সাথে জড়িত।
চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে কাঁকড়া রপ্তানি হয়। বিভিন্ন উৎসবে তারা কাঁকড়া খেতে বেশি পছন্দ করেন। আর এতে বাংলাদেশী কাঁকড়ার চাহিদা ব্যাপক। কারণ বাংলাদেশী কাঁকড়া স্বাদে অনন্য। অনেকটা ইলিশ মাছের মতো। কাঁকড়া চাষের একটি বড় সুবিধা হলো শৈত্যপ্রবাহ কিংবা গ্রীষ্মের দাবদাহে মারা যায় না।
তিন-চার মাসের মধ্যেই বিক্রয়যোগ্য হয়। কিন্তু সমস্যা হলো এই খাত সম্প্রসারণের জন্য সরকারের বিশেষ উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো নয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী আবারও রপ্তানি বহুমুখীকরণের ওপর বিশেষ জোর দিতে বলেছেন। কাঁকড়া চাষ, সংগ্রহ , বিপণন, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানির মাধ্যমে আমরা এই বহুমুখীকরণে এগিয়ে যেতে পারি।
কাঁকড়া ও কাঁকড়া চাষ নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা নেই। প্রাকৃতিক উৎস নির্বিঘ্ন করা নিয়ে কোনো উদ্যাগ নেই। দূষণে দূষণে পর্যুদস্ত এর উৎপাদনভূমি। কাঁকড়া চাষ নিয়ে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। আর্থিক সহযোগিতার কোনো উদ্যোগ নেই। নীতিগত সহায়তা পর্যাপ্ত নয়। অন্যদিকে বিশেষ কনজারভেশন পিরিয়ডে (কাঁকড়া ধরা, বহন, বিক্রয় ও বিপণনে নিষিদ্ধ সময়) এই পণ্যের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলদের বিকল্প কর্ম বা অর্থের সংস্থান নেই।
এমনকি এই কনজারভেশন পিরিয়ড অন্য যেকোনো পিরিয়ডের চেয়ে বেশি। পাঁচ মাস। ইলিশের ক্ষেত্রে যেখানে এক-দেড় মাস সেখানে কাঁকড়ার ক্ষেত্রে পাঁচ মাস। জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি আর জুন-জুলাই-আগস্ট। এক বছরের মধ্যে যদি পাঁচ মাস কোনো পণ্যের ওপর সংগ্রহে ও বিক্রয়-বিপণনে নিষেধাজ্ঞা থাকে এবং যারা এর ওপর নির্ভরশীল তাঁদের যদি বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা বা সরকারি প্রণোদনা না থাকে তাহলে এই তিন-সাড়ে তিন লক্ষ মানুষের পরিবার কীভাব জীবন যাপন করবে?
ফলে যা হবার তাই হয়। পেটে ক্ষুধা থাকলে নীতিবাক্য কানে ঢোকে না, মাথায়ও ঢোকে না হৃদয় লাথি মেরে ফেলে দেয়। ফলে নিষেধাজ্ঞার বাণী মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। তারা চোরাপথ অনুসরণ করে। তাতে দুই দিকেই ক্ষতি হয়। প্রথমত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে বিশেষ করে মাঘ মাসের পূর্ণিমায় কাঁকড়া ডিম ছাড়ে। এসময় তাদের গতি শ্লথ হয়ে যায়। ফলে কৃষকের হাতে সহজেই ধরা পড়ে যায়। দ্বিতীয়ত মা-কাঁকড়া ধরা পড়াতে পরবর্তী মৌসুমে কাঁকড়ার পরিমাণ কমতে থাকে। অন্যদিকে এই সময়ে কাঁকড়া-ভোজী দেশে কাঁকড়ার চাহিদা বেশি থাকে।
আরও পড়ুনএই সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। ইলিশ নিয়ে গবেষণা করে ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে আমরা যেমন ইলিশ-বিপ্লব ঘটিয়েছি। কাঁকড়া নিয়ে গবেষণা করে ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা কাঁকড়া-বিপ্লব ঘটাতে পারব। আমাদের কৃষি-বিজ্ঞানীরা যদি এগিয়ে আসেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি নীতি ও আর্থিক সহযোগিতা দেন, প্রজনন মৌসুম ও ডিমপাড়ার সময় কাঁকড়া শিকার না করা হয়, বিশেষ অভয়াশ্রম নির্মাণ করা হয় তাহলে কাঁকড়া-কৃষক ও কাঁকড়া ব্যবসায়ীগণ কাঁকড়া-বিপ্লব করতে পারবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
১৯৭৭-৭৮ সালে অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে দেশে প্রথম কাঁকড়া রপ্তানি হয়। রপ্তানি মূল্য ছিল ২৩ হাজার টাকা। কিন্তু কাঁকড়া আজ অপ্রচলিত পণ্য নয়। বিদেশে রয়েছে এই পণ্যর ব্যাপক চাহিদা। দেশে তারকা হোটেলগুলোতেও কাঁকড়ার চাহিদা রয়েছে। স্বাদ বৈচিত্র্যের জন্য ও সুস্বাদু হওয়ায় অনেকেরই কাঁকড়া ভাজি বিশেষ পছন্দের। আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়ার দাম ও চাহিদা বেশি। প্যাকেজিংও স্বল্পমূল্যের।
কারণ চিংড়ি খুব তাড়াতাড়ি মরে যায় ও দ্রুত পচনশীল। কাঁকড়া সহজে মরে না এবং ধীরে ধীরে পঁচে। উৎপাদন খরচ কম। বিক্রয়মূল্যও বেশি। আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ এই সম্ভাবনাময় খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বিশেষ উদ্যাগ গ্রহণ করবে।
লেখক : কবি-কথাসাহিত্যিক-ব্যাংক কর্মকর্তা
emrankabir81@gmail.com
01719-455492
মন্তব্য করুন