রেলপথে যাত্রীসেবা মান বাড়াতে হবে
যেকোন এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে সবকিছুরই ধারাবাহিক উন্নয়ন সম্ভব হয়। সহজ হয় সামনে এগিয়ে যাওয়া। আর এগিয়ে যাওয়ার এমন পথে যখন সেই যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার চেয়ে অসুবিধে পিছু ছাড়ে না, তখন কষ্ট বাড়তে থাকে সাধারণ মানুষের।
তেমনই উত্তরের যোগাযোগের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বপুর্ণ সান্তাহার থেকে লালমনিরহাট রেলওয়ে রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের যেন সে কষ্টই তারা করে ফেরে। এই রেলওয়ে রুটে চলাচলকারী বেশির ভাগ মেইল লোকাল ট্রেনের দীর্ঘদিনও কোন উন্নয়ন হয়নি। সেই দীর্ঘকাল আগে যে সুবিধা নিয়ে ট্রেনগুলো চালু হয়েছিলো, অনেকটা তেমনই আছে।
অন্তত দুই যুগ আগে যেকোন একটি ট্রেনের কম্পার্মেন্ট যা ছিলো, তাই আছে। চলাচলকারী ট্রেনগুলোতে যাত্রী সংখ্যা দিন দিন কয়েক গুণ বেড়ে গেলেও কম্পার্মেন্ট বাড়ানো হয়নি। এই এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে চলাচলকারী কলেজ ট্রেন নামক ট্রেনটির যাত্রীদের কষ্টের কথাই বলা যাক। প্রতিদিন এই ট্রেনের ভিতরে গাদাগাদি করে যাত্রীরা যাতায়াত করে থাকে।
আসন সংখ্যার চেয়ে অন্তত তিনগুণ যাত্রী করিডোর, দরজা, জানালা এমনকি ইঞ্জিনের চারপাশে উঠে চলাচল করে। আসন ছাড়াও যেন কোথাও ফাঁকা থাকে না। সব জায়গায় মানুষ। কম্পারমেন্টের ভিতরে নড়াচড়া করারও উপায় নেই। এই যখন ট্রেনের অবস্থা, তখন সন্ধ্যার পর পুরো ট্রেনটিতে থাকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু অন্ধকারই নয়।
অনেক দরজা জানালা ভাঙা। টয়লেটে দুর্গন্ধ। কোন পরিচর্যক না থাকা সহ নানা সমস্যায় অবর্ণনীয় কষ্টে যাতায়াত করেন, এ ট্রেনের সাধারণ যাত্রীরা। অপরদিকে ট্রেনটিতে টিকিট পরিদর্শক (টিটিই) না থাকায় প্রতিদিন বেহিসাবি যাত্রী টিকিট না করেই যাতায়াত করছে। গেল কয়েকদিন আগে পরিচিত একজন যাত্রী ট্রেনটির শেষ কম্পার্মেন্টে ওঠেন।
একটি কথা প্রসঙ্গে ট্রেনটির ভিতরে কষ্টের কথা জানিয়ে ওই যাত্রী বলেন, খুব কষ্টে এই ট্রেনে চলাচল করতে হয়। অতি কষ্টে বসার আসন পাওয়া গেলেও মানুষের ঠেলাঠেলিতে অসহীয় অবস্থায় পড়তে হয়। অন্ধকারে গাদাগাদি করে ট্রেনটিতে চলাচলে যাত্রীরা নিরাপত্তা হীনতায় থাকেন। অন্তত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে চলাচল করলেও কোন সংস্কার কিংবা উন্নতি হয়নি ওই ট্রেনের। দির্ঘদিনের পুরাতন হওয়ায় অনেক কম্পারমেন্টে পাটাতন উঠে দেবে গেছে।
বেশকিছু জানালা ভাঙা থাকায় বৃষ্টি আসলে আসনে বসে থাকতে পারে না যাত্রী। চলাচলকারী আরও অন্যান্য ট্রেনেরও প্রায় একই অবস্থা। সান্তাহার থেকে পঞ্চগড় পর্যন্ত চলাচল করে দোলনচাঁপা নামের একটি ট্রেন। নির্ধারিত সময়সুচি মেনে কখনোই চলাচল করে না। সময় মত স্টেশনে এসে অপেক্ষার প্রহর গুণতে হয় যাত্রীদের।
এ ট্রেনটি প্রতিদিন সকাল ৬টায় পঞ্চগড় থেকে বগুড়ার সান্তাহারের উদ্দেশে ছেড়ে দেয়। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুর ও গাইবান্ধা, বোনারপাড়া সহ মোট ১৭টি স্টেশনে যাত্রা বিরতি করে গন্তব্যে পৌঁছায় বিকাল ৩টা ৫০মিনিটে। দ্বিতীয় র্যাক সান্তাহার স্টেশন থেকে সকাল ১১টায় ছেড়ে গিয়ে একই ভাবে পঞ্চগড়ে পৌঁছে রাত ৮টা ২০মিনিটে। ট্রেনটির ১০টি বগিতে ২৭টি নন এসি প্রথম শ্রেণি, ১৮০টি শোভন ও ২৮৮টি সাধারণ শোভন মিলে ৪৯৫টি আসন রয়েছে।
আরও পড়ুনসড়ক পথে সহজ ও ভাল যোগাযোগ না থাকা বেশ কিছু উপজেলার মানুষ এই ট্রেনের উপর ভরসা করে বগুড়া ও রংপুর শহরে যাতায়াত করে। দুই শহরে চিকিৎসা, পড়াশুনা ও ব্যবসায়িক কাজে এই ট্রেনটিতেই যাতায়াত করতে হয় হাজার হাজার যাত্রীকে। প্রতিদিন দেরিতে চলাচল করায় বিড়ম্বনায় পড়েন যাত্রীরা। সময়সুচি মেনে নিয়মিত চলাচল না করে লোকাল ট্রেনের গতিতে চলছে ট্রেনটি। এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট করেও সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে লোকাল ট্রেনের ন্যায়।
এভাবে ট্রেনগুলো কোনটাই সময় মেনে চলাচল করছে না। দীর্ঘদিনের পুরনো ইঞ্জিন দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চালানো হচ্ছে ট্রেনগুলো। এছাড়াও জনবলের সংকট থাকায় এই রুটে বেশ কিছু স্টেশন ক্লোজডাউন (বন্ধ) করে রাখা হয়েছে। স্টেশন বন্ধ থাকায় কোন ক্রসিং হয় না।
যে কারণে একটি ট্রেন এক স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকলে, দির্ঘ সময় পর আরেকটি ট্রেন আসে। এতোসব সমস্যার মাঝেও এ এলাকার যাত্রীদের অনেকটা আশা জাগিয়েছিলো বগুড়া-ঢাকা রেলপথ নির্মাণের খবর। বগুড়া সহ বৃহৎ উত্তর এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো বগুড়া-ঢাকা রেলপথ নির্মাণের। এ এলাকার প্রায় ১০টি জেলার মানুষকে ট্রেনে ঢাকায় যেতে অতিরিক্ত ১১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়।
ট্রেনের এই যোগাযোগ সহজ না থাকায় অধিক সময়ের বিড়ম্বনা পোহাতে হয় যাত্রীদের। যে কারণে বগুড়া থেকে সরাসরি যমুনা সেতু হয়ে ঢাকায় যেতে রেলপথ নির্মাণের স্বপ্ন দেখে এ এলাকার মানুষ। এ এলাকার মানুষ এ স্বপ্ন দেখতে দেখতে অনেক সময়ও পার করেছে। ইতোপূর্বে বাস্তবায়নের আশ^াসও এসেছে অনেক।
কয়েক বছর আগে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়ার কথা পত্র পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়। বগুড়া শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে রাণীরহাটে রেলজংশন নির্মাণ সহ এ রুটের শেরপুর, চাঁন্দাইকোনা, রায়গঞ্জ, কৃষাণদিয়া ও সদানন্দপুরে রেলস্টেশন স্থাপন, প্রস্তাবিত ৮৪ কিলোমিটার রেলপথের জন্য ৯৬০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব, বগুড়ায় ৫২ কিলোমিটার রেলপথের জন্য ৫১০ একর এবং সিরাজগঞ্জের ৩২ কিলোমিটারের জন্য ৪৫০ একর জমি অধিগ্রহণের কথাও জানা যায়।
সময় অতিবাহিত হলেও এ কাজের অগ্রগতি আর তেমন দৃশ্যমান নেই। এ এলাকার ট্রেন যাত্রীদের সমস্যা দূর করে যাত্রী সেবা বাড়াতে হবে। তাহলেই এগিয়ে যাবে মানুষের স্বপ্ন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও কলাম লেখক।
মন্তব্য করুন