ভিডিও

চব্বিশেও তারুণ্যের জয়ধ্বনি

মাহমুদা টুম্পা

প্রকাশিত: আগস্ট ১৯, ২০২৪, ০৭:১৫ বিকাল
আপডেট: আগস্ট ১৯, ২০২৪, ০৭:১৫ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

ইতিহাস কথা বলে। ইতিহাস কথা বলে বর্তমানের, ইতিহাস কথা বলে সুদূর ভবিষ্যতের। তবুও আমরা ইতিহাস ভুলে যাই। ভুলে যাই ছাত্রদের আত্মত্যাগের কথা, ভুলে যাই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা। দেশটা যখন কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত, স্বৈরশাসকের হাতে জীর্ণশীর্ণ, বৈষম্যের চাদরে যখন গোটা পৃথিবী আচ্ছন্ন ঠিক তখনই ছাত্রসমাজ গড়ে তোলে নবদিগন্ত। ছাত্রসমাজ জাতির আশা ভরসার একমাত্র কেন্দ্রস্থল, জাতীয় জীবনের যে কোন মুহূর্তে তারা জীবন দিতে সদা প্রস্তুত।

ইতিহাসের পাতায় ছাত্র সমাজের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন। পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী সেদিন আমাদের মাতৃভাষাকে এ পৃথিবী থেকে বিদায় করার ষড়যন্ত্রে বিভোর ছিল।

বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা সেদিন ঢাকার রাজপথে তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ গৌরবদীপ্ত দায়িত্ব পালন করেছেন , ১৯৬২ সালের অগণতান্ত্রিক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল।

১৯৬৬ সালের ছয় দফা প্রণয়নে ছাত্রসমাজের সংগ্রামী ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে সচেতন ছাত্রসমাজ রেখেছে দৃষ্টান্তযোগ্য ভূমিকা। আবার ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগ্রামী ছাত্রসমাজ স্মরণযোগ্য অবদান এবং ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের উত্তাল দিনগুলোতে সংগ্রামী ছাত্রসমাজের ব্যাপক ভূমিকা জাতি কখনো ভুলবে না।

এসব ছোটবেলা থেকে বইয়ে পড়েছি। কিন্তু আমার ছোট্ট জীবনে কখনো ছাত্র আন্দোলন দেখার সৌভাগ্য হয় নি, সৌভাগ্য হয় নি মুক্তিযুদ্ধ দেখার। তবে আমি ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন দেখেছি। দেখেছি ছাত্ররা তাদের  ন্যায্য সংগ্রামে কতটা তৎপর।

'সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে' স্লোগানকে কেন্দ্র করে যাত্রার সূচনা হয়। ধীরে তা বাংলা ব্লকেডে রূপ নেয়। ৫৬ শতাংশ কোটা সংস্কারে অনড় বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীরা। একই ব্যানারে শাহবাগসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শুরু হয় মিছিল।

মিছিলে ছিল না সংঘাতপূর্ণ আচরণ, ছিলনা লুটতরাজ। শান্তিপূর্ণ মিছিলে ছিল একটাই চাওয়া মেধাবীদের মুক্তি দেয়া। কিন্তু তাদের দাবি মেনে নেয়া হলো না। রাজাকার বলে গালি দেয়া হলো। বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজ আরো বেশি সক্রিয় হলো আন্দোলনে।

কিন্তু শাসকশ্রেণি সমাজ এটি মেনে নিলেন না। শুরু করলো অমানবিক নির্যাতন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো সরকারের নির্দেশে চালিত পুলিশ বাহিনী।

হল বন্ধ করে দেওয়া হলো। শাসকশ্রেণীর ডানহাত ছাত্রলীগও সাধারণ জীবনযাত্রাকে নরকক্ষেত্রে পরিণত করলো। একে একে শহীদ হতে লাগলো নিরপরাধ প্রাণ। রক্তাক্ত শিক্ষার্থীরা লাশ হয়ে ফিরল।

মিছিলে ঝরে গেল আবু সাইদ, মীর মুগ্ধ, ছোট্ট রিয়া, আসিফ, ওয়াসিম, সুমাইয়া, দীপ্ত, সিয়াম, জিল্লুর, সাজ্জাদ, মেহেদী, দুলাল, ইমরান, রাকিব, তোরাব, রূদ্র,সেলিম, রাসেলসহ নাম না জানা  আরো অনেকের নিষ্পাপ প্রাণ। মৃত্যুর শোক আন্দোলনকে আরো দ্বিগুণ করলো।

জেলায় জেলায় মিছিল তীব্র হতে লাগলো। বিক্ষোভ কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দিতেই থাকলো। ৯ দফা দাবি সূচনা করলো 'মার্চ ফর জাস্টিস' কর্মসূচি। কর্মসূচিতে আসা শিক্ষার্থীদের নির্যাতন চালানো হলো। শুরু হলো সংঘর্ষ, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। ছাত্রদের বল প্রযোগ করা হলো।

ঢাকা,খুলনা, বগুড়া, কুমিল্লায় আবারো ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকলো। ছাত্রদের লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ছড়িয়ে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করলো। সফল না হতে পেরে গুলি করলো। ছাত্রদের রক্ত পিচঢালা রাজপথে মিশে গেল। মিছিল থেকে গণহারে শিক্ষার্থীদের তুলে নেয়া হলো জেলখানায়।

কত নিষ্পাপ ছাত্রদের পিটুনি দেয়া হলো, গুলি করা হলো শুধুমাত্র শিক্ষার্থী হওয়ায়। পুলিশি আক্রমণে সবচেয়ে বেশি নিহত হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। সরকার ৩০ জুলাই শোকের দিন ধার্য করেছিল। জাতির কালো ব্যাচ ধারণ করার কথা ছিল সেদিনে।

কিন্তু প্রতিবাদী ছাত্রসমাজ সবাই লাল প্রোফাইল পিকচার আপলোড দিল ফেসবুকে। অনলাইনেও চলে ব্যাপক প্রতিবাদ সভা। দিগি¦দিক আন্দোলনের সামিল শিক্ষকদের পুলিশ ছাড়ল না, তাদেরকেও ধরে নিয়ে গেল জেলখানায়। কত অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে তাদের শুধুমাত্র ন্যায্য দাবির পাশে থাকার সমর্থনে পুরো ৩৬ দিন ধরে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে গেছে শিক্ষার্থীরা।

মৃত্যুভয়, আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কখন জানি প্রাণটা চলে যায়। তবে অন্ধকার পেরিয়ে প্রভাতফেরীর আলোক রেখা দেখা দিল। ৩৬ জুলাই স্বৈরশাসকের পতন হলো। 'লং মার্চ টু ঢাকা' অ্যাটাক কর্মসূচি সফল হলো। পরিস্থিতির ধকল সহ্য না করতে পেরে স্বৈরাচার শাসক নিজেই পদত্যাগ করলেন। ৫ আগষ্ট দ্বিতীয় স্বাধীনতার দিন উপহার দিল ছাত্রসমাজ।

আন্দোলনে বেওয়ারিশ অনেক লাশ দাফন করা হয়েছে। এর মধ্যেই শুরু হয়েছিল ইন্টারনেট বন্ধের নাটক। না জানি এসময় কত মানুষের প্রাণ চলে গেছে তা সরকারি খাতায় আসবে না। আসবে না ফিরে মায়ের বুকের ধন বেগম রোকেয়ায় মেধাবী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ।

যিনি কোটা যুদ্ধে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন। আসবে না ফিরে শত শত প্রাণ যারা মৃত্তিকায় মিশে আছে বুলেটের আঘাতে। ফিরে আসবে না আর বেওয়ারিশ লাশ, যার জন্য হয়ত এখনো মা বাবা পথ চেয়ে বসে আছে। যার জন্য এখনো তারা অপেক্ষা করছে। ফিরে আসবে না ছোট্ট রিয়া,  ফিরে আসবে না আলোকিত বাংলায় মেধাবীদের প্রিয় মুখ।

আমাদের ছাত্রসমাজের অতীত অতি গৌরবদীপ্ত। জাতির সংকটকালীনবিভিন্ন সময়ে তারা যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছে তা অনুকরণ ও অনুসরণযোগ্য। সেই অনুকরণের ধারায় ২০২৪ সাল হয়ে ওঠে ভয়াবহ ছাত্র আন্দোলনে। একটা কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ দেয় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনে।

অসহযোগ আন্দোলনে আজ বাংলা আবারো মুক্তি পেল। মুক্তি পেল জাতি। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনও ব্যাপক ভূমিকা ছিল ছাত্রদের। সেখানেও সফল ছিল শিক্ষার্থীরা। বারে বারে সাফল্যের ধারাবাহিকতা এভাবেই ছিনিয়ে আনে তরুণসমাজ।

আপদকালীন মুহূর্তে ছাত্রসমাজ অগ্রণী এবং সাহসী ভূমিকা পালন করেছে তা পুরোদমে অনুধাবন করলাম ২০২৪ সালে। আমাদের ৬ সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, নুসরাত তাবাসসুম, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার যেন তারুণ্যে উজ্জ্বল দীপ্তি।

তাদের যখন ধরে নিয়ে জোরপূর্বক দাবি তুলে নেওয়ার বিবৃতি দেয়া হলো ঠিক তখনই চতুর শিক্ষার্থীরা বিকল্প সমন্বয়ক তৈরি করলো। সব ষড়যন্ত্রকে তুচ্ছ করে আন্দোলনের বেগ বাড়াতে লাগলো। ভয়াল আন্দোলনের তোপে পড়ে ৬ সমন্বয়কে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পুলিশ।

আমাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়করাও, ভবিষ্যতের কান্ডারী,নবশক্তির উদ্ভাবক। নবশক্তির উদ্ভাবকরা স্বৈরশাসকের পতন ঘটান নি, সূচনা করেছে নতুন বাংলা। গণভবন থেকে নিয়ে আসা সবকিছু ফেরত দেয়া হয়েছে তাদের আহ্বানে। নিষ্ঠা ও যত্নের সাথে জাতীয় সংসদসহ রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। গাছ লাগানো, দেয়ালে রং করা থেকে ট্রাফিক পুলিশের কাজ দক্ষতার সাথে সুসম্পন্ন করেছে।

বাজার মনিটরিংও করেছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে মুসলিমরা মন্দির পাহারা দিচ্ছে। ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচতে টিম করে কাজ করছে। শহীদ ভাইদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্জ্বলিত হয়েছে।  অভিভাবকহীন অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে বাংলার গুরু দায়িত্ব দিয়েছে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। চেষ্টা করেই যাচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশকে যেন সবসময় দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পারে।

কাজ করেই যাচ্ছে কোন দুষ্ট চক্রের রাজনৈতিক হাতিয়ার যেন বাংলাদেশ আর না হয়। এমনকি পুরনো সব রেকর্ড ভেঙে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হয়েছে তরুণ সমাজের নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

বর্তমানের জেড জেনারেশন নাকি ফেসবুক, টিকটকের ভিডিওতে মগ্ন। তারা নাকি নষ্ট হয়ে গেছে। মুরুব্বিদের ধারণা এ ছাত্রসমাজ একটু বিপদে হটিয়ে যাবে, দৌড়ে পালাবে দেশ থেকে। এরা নাকি দেশকে ভালবাসে না। কিন্তু কি হলো অবশেষে। সর্ব প্রথম আন্দোলনে ছিল ছাত্ররা। যে ছাত্রসমাজ ন্যায্য দাবির আন্দোলনে শিক্ষকদের ঘুম ভাঙ্গায় সে জেনারেশন নষ্ট হয় নি।

জ্ঞানশক্তি ও তারুণ্যশক্তির সমন্বয়ে এ জাতিও দেশমাতৃকাকে বাঁচাতে সদা প্রস্তুত। চব্বিশেও তারুণ্যের জয়ধ্বনি। আরো একবার বিজয় আনল তরুণ সমাজ। যা পারে নি বিপক্ষের কোনো রাজনৈতিক দল। ইতিহাসের বিভীষিকাময় ক্রান্তিলগ্নে মহাবিপ্লবের সামিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ২০২৪ সাল এই শিক্ষায় দেয় ছাত্ররা কখনো পিছু পা হটে না, ছাত্ররা রাজপথে মহাজাগরণের বিপ্লবে মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে- নতুন স্বপ্ন জুড়ে দেয় জাতির ভাগ্যাকাশে।


লেখক : শিক্ষার্থী
ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
কুষ্টিয়া



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS