‘জুলাই বিপ্লবের’ তথ্য সংরক্ষণে দুই ওয়েবসাইট; প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র জনতার জীবন দানের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার ত্যাগের মহিমা বিশ্ববাসীর কাছে ছড়িয়ে দিতে ও অপপ্রচার রুখতে ‘শহিদ ডট ইনফো’ এবং ‘চিনে রাখুন’ নামের দুইটি ওয়েবসাইট তৈরী করেছেন জসীম উদ্দিন এবং নুর মোহাম্মদ মামুন। জসীম উদ্দিন পেশায় থাইল্যান্ডের একটি কোম্পানির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং নুর মোহাম্মদ বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) থেকে পড়াশুনা শেষ করা তরুণ।
জসীম উদ্দিন থাইল্যান্ডে অবস্থান করলেও দেশে তার ২৩ জনের একটি দল রয়েছে। তারা আহত ও নিহতদের তথ্য, ছবি ও অন্যান্য বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে যাচাইয়ের কাজটি করেন। ‘চিনে রাখুন’ তৈরির ভাবনা শাবাব জুনায়েদের হলেও সাইটটি তৈরি করেছেন তার বন্ধু নুর মোহাম্মদ মামুন। তাদের পুরো টিম থাকেন ঢাকাতেই। সাইটটিতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা-আক্রমণকারীদের বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও আপলোড করা হয়।জুলাইয়ের মাঝামাঝি কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতা ও প্রাণহানিকে কেন্দ্র করে সারা দেশ যখন উত্তাল, তখনই একটি ‘ডেটা ব্যাংক’ তৈরির ভাবনা আসে জসীম উদ্দিনের মাথায়। শিক্ষার্থীদের জোড়ালো আন্দোলন আর হামলা-সংঘর্ষে হতাহতদের সংখ্যা ও পরিচয় সংরক্ষণে তখন একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেন তিনি; নাম দেন ‘শহীদ ডট ইনফো’। এ ওয়েবসাইটে এখন পর্যন্ত ৪৯০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর তথ্য এসেছে, আহতদের তালিকায় রয়েছে ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ। গ্রেপ্তার ও নিখোঁজের হিসাব দেওয়া হয়েছে ১১ হাজারের বেশি। আন্দোলনের মধ্যে অল্প সময়েই ওয়েবসাইটটি অনেকের কাছে পরিচিতি পায়।
জসীমউদ্দিনের গণমাধ্যমে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আন্দোলনের ইতিহাস যেন কোনোভাবে লুকানো বা বিকৃত না হয়, সেজন্যই এ সাইট তৈরি করা। এখানে আন্দোলনে নিহত ও আহতদের সংখ্যা দেখা যাবে। জসীম উদ্দিনের বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করা এ তরুণ ‘শহীদ ডট ইনফো’ ওয়েবসাইট খুলেছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগেই।ছাত্র-জনতার ৩৬ দিনের আন্দোলনে হতাহতদের পরিসংখ্যানের বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগে কোনো ডেটাবেইজ বা ওয়েবসাইট তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল মান্নান মাসুদ। আন্দোলনে ‘শহীদ ডট ইনফো’ থেকেই তথ্যগত সহায়তা নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।সমন্বয়ক মাসুদের সাদ্যমে জানা যায় , বৈসম্য বিরোদী ছাত্র আন্দোলনের বিজয় পরবর্তী কিংবা পূর্বের তাদের নিজস্ব কোনো ওয়েবসাইট করা হয়নি, তবে তাদের পরিকল্পনা আছে।
সরকার, আন্দোলনকারী ও সংবাদমাধ্যমের হিসাবে হতাহতের সংখ্যা বিভিন্নরকম। অল্প কিছুদিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন মৃত্যু সংখ্যা হাজারের বেশি। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এই সংখ্যা ৬৫০ বলা হয়েছে। আবার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের হিসাবে ছয়শ থেকে সাতশর মধ্যে কয়েক রকম সংখ্যা এসেছে।
‘শহীদ ডট ইনফো’
কোটা সংস্কার আন্দোলন পরে সরকারপতনের এক দফার আন্দোলনে রূপ নিলে ৪ অগাস্ট সংঘাত, সংঘর্ষ আর গুলিতে এক দিনেই একশ জনের মৃত্যুর তথ্য আসে সংবাদমাধ্যমে। পরদিন ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির দিন দেশজুড়ে আরও শতাধিক মানুষের প্রাণহানির খবর আসে। তুমুল গণআন্দোলনের ওই দিনেই প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। গোটা আন্দোলনে হতাহতের হিসাব রাখতে গিয়ে সরকারি রোষানলেও পড়ার কথা গণমাধ্যম’কে জানান ‘শহীদ ডট ইনফো’র জসীমউদ্দিন। শিক্ষার্থীদের নয় দফার আন্দোলনের সময় সাইটটি বাংলাদেশে ব্যান করা হয়েছিল। সরকারপতনের পর ব্যান তুলে নেওয়া হয়। তথ্য প্রকাশের আগে সেই ব্যক্তি মারা গেছেন নাকি আহত হয়েছেন তা যাচাই করা হয়। যেন কোনো ভুল তথ্য প্রকাশ না পায়।
যাচাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যায়, ফেইসবুকে হাজার হাজার পোস্টের মধ্য থেকে নিহত বা আহত হওয়া ব্যক্তির পরিবারের করা পোস্টগুলোই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। প্রায় ১০ জনের আইটি ও ভেরিফিকেশন টিম তাদের কাছে আসা পোস্টগুলো ভেরিফাই করার কাজ করেন দেশজুড়ে। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্বাসযোগ্য পত্রিকার তথ্যও আমলে নেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে একটি গুগল ফর্মে ডেটা সংগ্রহ করছেন তারা, তথ্যগুলো যেন কোনোভাবে ভুল না হয়, তাই দুই স্তরে হয় ভেরিফিকেশন।অন্য সদস্যরা তথ্য যাচাই করলেও তথ্য প্রকাশের কাজটি করে থাকেন জসীম নিজেই।হতাহতের তালিকা ছাড়াও ওয়েবসাইটে ‘ভার্চুয়াল মিউজিয়াম’ নামে একটি ক্যাটাগরি যুক্ত করা হবে বলে জানান জসীম। সেখানে পুরো আন্দোলনকে ফুটিয়ে তোলা হবে। আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যবহার করা স্লোগান, প্ল্যাকার্ড, গ্রাফিতি, ছবি সংরক্ষণ করা হবে। এছাড়া ওয়েবসাইটে নিহত ও আহত হওয়া ব্যক্তিদের প্রোফাইল ব্যবহারের সুযোগ পাবেন পরিবারের সদস্য বা স্বজনরা। তারিখ ও ইভেন্ট ধরে ঘটনাপ্রবাহ লিখে রাখার কাজও চলছে বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন‘চিনে রাখুন’
আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর আক্রমণ চলাকালে ‘চিনে রাখুন’ ওয়েবসাইট তৈরির পরিকল্পনা করেন ওয়েবসাইটটির নির্মতা শাবাব। ‘অপরাধীদের’ দেশ ও বিশ^বাসী যেন চিনতে পারেন এবং তাদের আইনের আওতায় আনতে সহজ হয় সেজন্য তাদের এই প্রয়াস। অপরাধের তথ্য-প্রমাণ সংরক্ষণেও এটি ভূমিকা রাখবে বলে তার বিশ^াস। ৪ অগাস্ট চালু হওয়া এ সাইটে তথ্য যাচাইয়ের কাজ করেন তিনজন। সাতজন সংগ্রহ করেন তথ্য, সাবমিশনসহ অন্যান্য কাজও করছেন তারা। তবে ‘আক্রমণকারীর’ পরিচয় বা ছবি/ভিডিও প্রকাশের আগে শেষ ধাপের যাচাইয়ের কাজটি করেন শাবাব নিজে। সাইটটিতে বিস্তারিত পরিচয়, ছবি, ভিডিওসহ ৩০ জন ‘আক্রমণকারীর’ পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে।
‘চিনে রাখুন’ ওয়েবসাইটে আন্দোলনে ‘অফিসিয়াল ডেথ’ দেখানো হয়েছে ৪৩৯ জনের বেশি। আর আনুমানিক মৃত্যু দেখানো হয়েছে ১১৫০ জনের বেশি। এ ছাড়া ২১ হাজারের বেশি আহত দেখানো হয়েছে।
‘চিনে রাখুন’ ও ‘শহীদ ডট ইনফো’ সাইটে আন্দোলনের এসব তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে। এদিকে হতাহতদের পরিচয়সহ একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেজন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি, বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের সাধারণ জনতা আশায় বুক বেঁধে আছেন। জসীম-শাবাবদের সাথে কাজ করা তরুণদের হাত ধরে তথ্যপ্রযুক্তির এমন সর্বোত্তম ব্যবহারে ভবিষ্যত বাংলাদেশ অন্তত সঠিক উতিহাস জানতে ওজানাতে পারবে। বাংলাদেশে আর যেন কখনও স্বাধীনতার ঘোষণা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক বা আংশিক সত্যতা নিয়ে কোন বিতর্ক সৃষ্টি হবে না। ১৯৭২-১৯৭৫ সালের পত্রপত্রিকা এতোদিন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের গণ পাঠাগারে থাকলেও তা ছিলো পাঠকের নাগালের বাহিরে। ‘চিনে রাখুন’ ও ‘শহীদ ডট ইনফো’ এর মতো এমন ওয়েবসাইট থাকলে, মানুষ যে কোন সময় যে কোন স্থান থেকে জানতে পারবে ‘জুলাই বিপ্লব’ এর প্রকৃত ইতিহাস। ভবিষ্যতে কোন সরকার বা শাসন ব্যবস্থা প্রকৃত তথ্য জানতে বা জানাতে, গোপন বা আড়াল করতে পারবে না বাংলাদেশের বাঙ্গালীর ১৯৫২,১৯৭১ এর মতো আরও একটি গৌরবউজ্জ্বল অধ্যায় ‘জুলাই বিপ্লব’ ২০২৪।
মন্তব্য করুন