প্রাথমিক শিক্ষায় সংকট ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশে চলমান সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের হাত ধরে দেশে বিদ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা সহ রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে সংস্কারের যে ঢেউ উঠেছে, সেই ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। সচেতন মহল থেকে শুরু করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, এমনকি সাধারণ নাগরিকদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে দাবি উঠেছে শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের, বিশেষত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের।
উল্লেখ্য, গত শনিবার (১৭ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর মিরপুরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সামনে এক মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। ‘বৈষম্য নিরসনে প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার’ ও ‘বৈষম্যবিরোধী প্রাথমিক শিক্ষক সমন্বয় পরিষদ’ নামের দুইটি সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত সেই মানববন্ধনে অংশ নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কারের স্বার্থে বেশ কিছু দাবি দাওয়া তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা স্বাধীনতার পর থেকেই ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্প দেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনেকাংশেই সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তারপরও এদেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশ কিছু সংকট রয়েছে যা নিরসন করতে পারলে প্রাথমিক শিক্ষা খাত দেশের অন্যতম প্রধান সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আবির্ভূত হবে।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বিরাজমান সংকট সমূহের মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে ধরা হয় মামলা সংক্রান্ত জটিলতা। কতিপয় মামলাবাজ শিক্ষকের দায়ের করা মামলাসমূহের কারণে প্রাথমিক শিক্ষা খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশেষ করে সহকারী শিক্ষক পদের নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা ব্যবস্থার যথাযথ প্রয়োগ, সহকারী শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ, জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের কতিপয় শিক্ষক কর্তৃক প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দাবি করে দায়ের করা রিট, এটিইও পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রার্থিতা নির্ধারণ সহ বহুবিধ কারণে গত এক দশকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নমনীয় মনোভাব এবং সিদ্ধান্তহীনতার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয়েছে, যা অধিদপ্তরের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
এমতাবস্থায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতে দাঁড়িয়ে সদিচ্ছার সাথে মামলায় লড়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জটিলতার অবসান ঘটাতে পারলেই প্রাথমিক শিক্ষা খাত অনেক দূরে এগিয়ে যাবে। তবে প্রাথমিক শিক্ষা খাতের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে যে ব্যাপারটি, তা হলো সমন্বয়হীনতা। ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাতে শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত ১:২৯।
অথচ কিছু দিন পর পরই পত্র পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়, "শিক্ষক সংকটে পর্যুদস্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়"। যার মূল কারণ কিন্তু শিক্ষক স্বল্পতা নয়। বরং উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের মধ্যে সমন্বয়হীনতা। কখনো কখনো দেখা যায় কোনো একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৭০ জন বা তার আশে পাশে, অথচ শিক্ষক রয়েছেন ১০-১১ জন।
আবার হয়তো অন্য কোনো বিদ্যালয়ে দেখা যায় শিক্ষক আছেন দুই জন, অথচ শিক্ষার্থী সংখ্যা ১০০ জনেরও বেশি! এই ধরনের সংকট দূর করতে শিক্ষক শিক্ষার্থীর আনুপাতিক হারে উপজেলার মধ্যকার সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে "কর্মরত শিক্ষক সংখ্যা" সময়ে সময়ে সমন্বয় করতে হবে অর্থাৎ সমন্বয় জনিত কারণে শিক্ষক বদলির কার্যক্রম সারা বছরই চালু রাখতে হবে এবং সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য খাতের মতো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি তিন বছর পর পর বাধ্যতামূলকভাবে বদলির ব্যবস্থা করতে হবে।
অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সক্রিয় ভাবে কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা চারজনের কমে আনা যাবে না। তবেই মানসম্পন্ন শিক্ষাদান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্ট আরেকটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করতে হবে, আর তা হলো শ্রেণী কার্যক্রম বহির্ভূত আনুষঙ্গিক কাজের খড়গ!
সরকারি, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহের উপর উপবৃত্তি, ইউনিক আইডি, কাবিং, ক্ষুদে ডাক্তার, শুমারি, শিশু জরিপ, বিভিন্ন দিবস উদযাপন সহ বহুবিধ আনুষঙ্গিক কাজের চাপ থাকে। সময়ে অসময়ে এই সকল আনুষঙ্গিক কাজের পরিপত্র জারির যে প্রবণতা গড়ে উঠেছে, সেই প্রবণতা বহুকাল যাবত প্রাথমিক শিক্ষা খাতের গৌরব ও মর্যাদাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
উল্লেখ্য, এই সকল শিক্ষা বহির্ভূত আনুষঙ্গিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে গিয়ে শিক্ষকরা শ্রেণী কার্যক্রমের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। এমতাবস্থায় যদি শিক্ষা বহির্ভূত কার্যক্রম কিছু অংশে কমিয়ে আনা যায়, তবে হয়তো প্রাথমিক শিক্ষার সাংবিধানিক অঙ্গীকার অনেকাংশেই পূরণ করা সম্ভব হবে।
তবে এসব কিছুর বাইরে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা খাতে, যার একটি হলো কর্মঘণ্টা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, তাদের বয়স ৫ থেকে ১১ বছর পর্যন্ত; অর্থাৎ প্রাথমিকের সব শিক্ষার্থী হচ্ছে কোমলমতি শিশু। অন্যদিকে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয় সমূহে যে সকল শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, তারা প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের থেকে বয়সে বড়।
তারপরও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্মঘণ্টা অনেক বেশি। মাধ্যমিক বিদ্যালয় সমূহের কর্মঘণ্টা যেখানে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত, সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্মঘণ্টা সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত। একইসাথে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অংশীজন ধরা হয় যে সকল প্রতিষ্ঠানকে, সেই সকল প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ কিন্ডার গার্টেন এবং মাদ্রাসার সময়সূচিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক কম হওয়ায় অধিকাংশ অভিভাবক তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে চায় না।
আরও পড়ুনফলে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার সাংবিধানিক অঙ্গীকার অনেকাংশেই পূরণ করা সম্ভব হয় না। এদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বহুদিন ধরে বিদ্যালয়ের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনার দাবি করে আসছেন। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের দাবি মেনে নিয়ে তাদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে এনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত নির্ধারণ করলে, হয়তোবা এই সংকটটি নিরসন করা সম্ভব হবে। এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহ তার হারানো গৌরব ফেরত পাবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল চর্চিত সমস্যা হলো শিক্ষদের সম্মান ও বেতন কাঠামো। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এবং বেশি বেতনের চাকরিগুলোর একটি। আর বাংলাদেশে অনেকাংশেই তার বিপরীত। এদেশে শিক্ষকরা বিশেষত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাষ্ট্রের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী, যা সত্যিই হতাশাজনক এবং লজ্জার!
গত ২৬ শে মে ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, "প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনের পরিমাণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৫তম আর দক্ষিণ এশিয়ায় সপ্তম।
এদেশের প্রাথমিকের শিক্ষকদের গড় বেতন ১৭০ ডলার ২ সেন্ট, যা দেশের মাথাপিছু গড় মাসিক আয়ের তুলনায় প্রায় ৬২ ডলার কম।" তাই প্রগতিশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা খাতের উন্নয়নের স্বার্থে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।
আর যদি কোনোভাবে সেই আলাদা বেতন কাঠামো তৈরি করা সম্ভব হয়, তাহলে হয়তো দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় আসবে এবং বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বলে রাখা ভালো, সাম্প্রতিক অতীতকালেও একটি সমস্যার কথা নিয়মিতই শোনা যেতো শিক্ষকদের কাছে থেকে। আর তা হলো ক্যাডার সার্ভিসে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নিজস্ব কোনো ক্যাডার না থাকা। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ এবং নীতিনির্ধারণী পদগুলোতে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নয় এমন ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগ প্রদান করায়, এবং তারা পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ায় গৃহীত পরিকল্পনা সমূহ বাস্তবায়ন করতে পারেন না।
ফলে ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। সেক্ষেত্রে, ক্যাডার সার্ভিসে প্রাথমিক শিক্ষা নামক একটি ক্যাডার খুলে এবং সহকারী শিক্ষক পদটি কে "এন্ট্রি পদ" ধরে প্রধান শিক্ষক পদ থেকে শুরু করে একেবারে মহাপরিচালক পর্যন্ত শতভাগ পদোন্নতি দেয়া সম্ভব হলে, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাত উন্নত দেশসমূহের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে এক নিদারুণ উপভোগ্য প্রতিযোগিতা উপস্থাপন করবে বলে আশা করি।
সর্বোপরি বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাতের ব্যাপক সংস্কার তথা বিদ্যমান উপরিউক্ত সংকট সমূহ নিরসনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার এদেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাতের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করবে এবং বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি "রোল মডেল" হিসেবে উপস্থাপন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করি।
লেখক : শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক।
সহকারী শিক্ষক, শালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ
monir.shohag120807@gmail.com
01768-878441
মন্তব্য করুন