ভিডিও রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি ও প্রতিকার

স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি ও প্রতিকার

স্তন ক্যান্সার কি?

'স্তন' লক্ষ লক্ষ কোষের সমন্বয়ে গঠিত একটি অঙ্গ যার একটি মাত্র কোষের অনিয়ন্ত্রিত এবং অস্বাভাবিক বিভাজন থেকে স্তন ক্যান্সার বা টিউমারের উৎপত্তি।  'স্তন' মূলত কতগুলো দুগ্ধগ্রন্থি (মিল্ক গ্ল্যান্ড), মায়ের দুধ প্রবাহের জন্য দুগ্ধ নালী (ডাক্ট) এবং গ্রন্থিকে ঘিরে থাকা চর্বি ও আঁশ জাতীয় টিস্যু নিয়ে গঠিত। প্রতিটি গ্রন্থি ১২-১৬টি লোব এবং প্রতিটি লোব ৩০/৪০টি লোবিউল এ বিভক্ত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাবে এসে শেষ হয়। স্তন ক্যান্সার সাধারণত এসব দুগ্ধনালী বা গ্রন্থির কোষ থেকেই প্রথম শুরু হয়।

ঝুঁকি সমূহ 
বয়স: বাড়ার সাথে সাথে স্তন ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বা সম্ভাবনা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
পারিবারিক ইতিহাস: রক্তসম্পর্কীয় কোন আত্মীয় যদি স্তন, কোলন বা ডিম্বাশয় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তবে আপনার স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কিছুটা বেড়ে যায়। এ ঝুঁকি আরো বৃদ্ধি পায় যদি অতি নিকটজন (যেমন- মা, বোন, খালা, ফুফু) ৫০ বছর বয়সের পূর্বে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন অথবা পরিবারে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা দুই বা এর অধিক হয়। থাকলে অতিসত্বর আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

ঋতুস্রাব: অল্প বয়সে ঋতুস্রাব শুরু হওয়া এবং বেশি বয়সে স্রাব বন্ধ হলে শরীরে দীর্ঘ দিন “ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাব থাকে, যা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপী: ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়ার সময় হলে অনেক নিয়ে থাকেন, যা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তবে হরমোন থেরাপী বন্ধ করে দিলে এ ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসে।
জন্মনিয়ন্ত্রন বড়ি গ্রহণ: দীর্ঘ সময় ধরে জন্মনিয়ন্ত্রন বড়ি সেবন স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বাড়িয়ে দেয়। তবে বড়ি সেবন বন্ধ করে দিলে ধীরে ধীরে তা কমে যায়।
স্থুলতা: শরীরে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার সাথে হরমোনের সম্পর্ক থাকায় তা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণ ঘটায়। অতএব এখনই চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করুন এবং নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন।
মদ্যপান: মদ্যপানের ফলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়, অতএব তা পরিহার করুন।
স্তন ক্যান্সার শনাক্তকরণ ও তার প্রতিকার: প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার সনাক্তকরণ এবং আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগের ফলে বিশ্বে আজ বহু নারী স্তন ক্যান্সারের অভিশাপ থেকে মুক্ত। কেবলমাত্র আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে স্তন ক্যান্সারের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই এর প্রতিকারের জন্য প্রয়োজন সঠিক ধারণা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা।

উপসর্গসমূহ : স্তনে বা বগলে চাকা দেখা দেওয়া, সাধারণত ব্যাথাহীন থাকে। স্তনের ত্বকের রং পরিবর্তন, সাধারণত লালচে হয়ে যাওয়া, চামড়া পুরু হয়ে যাওয়া, ঘা হওয়া, পশমের গোড়া ফুলে যাওয়া। স্তনের বোটায় পরিবর্তন, চুলকানো বা পার্শ্ববর্তী অংশ লাল হয়ে যাওয়া । স্তনের আকার আকৃতির পরিবর্তন বা যেকোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা। স্তনের বোটা দিয়ে যেকোনো ধরনের নিঃসরণ যেমন- রক্ত, পুঁজ বা পানি

সনাক্তকরনের জন্য পরীক্ষাসমূহ: নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা(Self Breast Examination)। স্তনের ডাক্তারি পরীক্ষা(Clinical Breast Examination)। ম্যামোগ্রাফি, আলট্রাসনোগ্রাফী অব ব্রেস্ট, এফ এন এ সি, কোর নিডিল বায়োপসি, ইমিউনো হিস্টোকেমিস্ট্রি, FISH টেস্ট, জেনেটিক / মলিকুলার টেস্ট' - BRCA1,2, P53। এছাড়া স্টেজিং ও সাধারণ পরীক্ষা সমূহ তো আছেই।

কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন: যে কোনো চাকা অনুভব হলে অবশ্যই ডাক্তারি পরীক্ষার মাধ্যমে এর ধরন নির্ণয় করতে হবে, বিশেষ করে চাকাটি যদি মাসিক হবার পরও মিলিয়ে না যায়, আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে অথবা ব্যথা থাকে। স্তনের চামড়ায় কোন পরিবর্তন হলে যেমন, কুঁচকানো ভাব, লোমকূপের ছিদ্র বড় হয়ে যাওয়া অথবা রঙের কোন পরিবর্তন। অথবা স্তনবৃত্ত ভিতরের দিকে ঢুকে গেলে অথবা এ থেকে কোন অস্বাভাবিক ডিসচার্জ বা রস বের হলে, ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

আরও পড়ুন

স্তনের কি কি পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়: অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলারা নিজেরাই প্রথম তাদের স্তনের অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করে থাকেন। কিন্তু সব পরিবর্তনই ক্যান্সারের লক্ষণ নয়, তাই কোন অস্বাভাবিক অবস্থা লক্ষ্যনীয় হলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।

লক্ষ্য করুনঃ স্তনের আকার, আকৃতি ও রঙ এর পরিবর্তন আছে কিনা। স্তনের ত্বকে কোন পরিবর্তন (পুরু বা পাকা কমলার খোসার মত) হয়েছে কিনা। স্তন বা বগলের নীচে কোন চাকা বা পিন্ড অনুভূত হয় কিনা। স্তন বৃন্তের কোন পরিবর্তন (ডেবে যাওয়া, রস বা রক্ত নিঃসৃত হওয়া) আছে কিনা। যে কোন এক দিকে ব্যথা অথবা যে কোন ধরনের অস্বস্তি অনুভূত হওয়া ৪০ বা তদূর্ধ্ব বয়সী মহিলাদের জন্য ব্রেষ্ট স্ক্রিনিং এবং সবাইকে সচেতন করার মাধ্যমেই প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যান্সার সনাক্তকরন সম্ভব। মনে রাখবেন নারী হয়ে জন্মানোই স্তন ক্যান্সারের একটি ঝুঁকি। তবে পুরুষরাও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে, যা প্রতি ১০০ জন মহিলার অনুপাতে ১জন (১০০:১)। স্তনের সকল পরিবর্তনই ক্যান্সার নয়। স্তন ক্যান্সার মানেই নিশ্চিত মৃত্যু নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় হলে, উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগ প্রায় শতভাগ নিরাময় যোগ্য।

চিকিৎসাসমূহ
সার্জারিঃ স্তন রেখে চিকিৎসা (lumpatomy): শুধুমাত্র আক্রান্ত অংশটা রেখে কেটে ফেলা হয়। এরপর ব্রেস্ট রিকনট্রাকশন করা হয়। সম্পূর্ণ স্তন কেটে ফেলা হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বগলের এ লসিকাগ্রন্থিসহ। কেমোথেরাপী, রেডিওথেরাপী, হরমোন থেরাপী, টার্গেটেড থেরাপী, বোন ডাইরেক্টেড থেরাপী।

ফলাফল: চিকিৎসার মাধ্যমে ৫ বছর ভালো থাকার সম্ভাবনাঃ
সীমিত অবস্থায় – ৯৯ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে ছড়ালে ৮৬ শতাংশ, দূরবর্তী অংশে ছড়ালে ৩১ শতাংশ।

স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করবেন কিভাবে?
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম: সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হালকা শারীরিক পরিশ্রম আপনার ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুলাংশে কমাতে পারে। আপনি যত বেশি শারীরিক পরিশ্রম করবেন তত বেশি ঝুঁকি কমাতে সক্ষম হবেন।
ব্রেস্টফিডিং: শিশুকে দীর্ঘদিন ধরে (পূর্ণ ২ বছর) মায়ের বুকের দুধ পান করানো হলে শরীর দীর্ঘ সময় ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবমুক্ত থাকে। ফলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পায়।
সন্তান গ্রহণ: পরিণত বয়সে, সাধারণত ৩০ বছর বয়সের মধ্যে এক থেকে দুটি সন্তান গ্রহন অনেকাংশে আপনার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সক্ষম ।
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যগ্রহণ: প্রতি দিনের খাদ্য তালিকায় মাংস, চর্বি ও শর্করা জাতীয় খাবার কমিয়ে এবং শাক-সবজি, ফলমূল ও আঁশযুক্ত খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব ।
স্ক্রিনিংঃ নিয়মিত ব্রেষ্ট স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যান্সার সনাককরণ সম্ভব যা কিনা রোগমুক্তির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। যাদের স্তন ক্যান্সার বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে তারা তো বটেই অন্যরাও নিয়মিত স্ক্রিনিং করা উচিত।
৪০ বা তদূর্ধ্ব বয়সীদের জন্য সেল্ফ ব্রেষ্ট এক্সামিনেশন প্রতি মাসে এবং ক্লিনিকাল ব্রেষ্ট এক্সামিনেশন অথবা ম্যামোগ্রাম ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী করা উচিত।
বছর বা মাসের সময়ভেদে অনেকের পরিবর্তন হতে পারে তাই স্তনের স্বাভাবিক অবস্থা সম্পর্ক জানুন। এতে করে অন্যের যে কোন অস্বাভাবিক পরিবর্তন সহজেই লক্ষ্য করা সম্ভব। তাই নিজেকে সময় দিন এবং আপনার সময় ও সুবিধা অনুযায়ী নিজ দেহের স্বাভাবিকতা সম্পর্কে অবগত থাকুন।


টিউমার ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ
ডা. মোঃ তৌছিফুর রহমান
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), এমডি (অনকোলজি)
কনসালটেন্ট, টিএমএসএস ক্যান্সার সেন্টার, বগুড়া।
চেম্বারঃ ইবনে সিনা কনসালটেশন সেন্টার,কানজগাড়ী, বগুড়া

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাতক্ষীরার শ্যামনগরে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার

আন্দোলনে যাচ্ছেন ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা

রাজশাহীতে নেসকো’র ভৌতিক বিল বন্ধসহ নানা হয়রানির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শীতকালীন ছুটি, বহিরাগতদের প্রবেশে বিধি-নিষেধ

টাঙ্গাইলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাবা-ছেলের মৃত্যু

ছেলের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মায়ের মৃত্যু