অনলাইনের মাধ্যমে সাড়ে ১১ লাখ টাকার কাজুবাদাম বিক্রি করেছেন অরুনা
সাজেদুর আবেদীন শান্ত: শিরীন সুলতানা অরুনা, বসবাস করেন রাঙামাটিতে। পরিশ্রম, উদ্ভাবনী চিন্তা আর আত্মবিশ্বাসের মিশেলে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। যিনি ছোট পরিসরে হাতের তৈরি ক্রিস্টাল ব্যাগ তৈরি করে তার যাত্রা শুরু করেছিলেন। সামাজিক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে একসময় গড়ে তোলেন নিজের প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে কাজ শুরু করেন পার্বত্য অঞ্চলের কাজুবাদাম এবং স্থানীয় পণ্য নিয়ে, যা অনলাইনে ব্যাপক সফলতা পায়।
অরুনা শুধুমাত্র অনলাইনেই স্থানীয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজু বাদাম বিক্রি করেছেন প্রায় সাড়ে ১১ লাখ টাকার। বর্তমানে তার তত্ত্বাবধানে কাজ করছেন ২০ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক। তার এই চমকপ্রদ সাফল্য ও সাহসী পথচলার গল্প, নিয়ে কথা হয় দৈনিক করতোয়ার সঙ্গে। উদ্যোক্তা জীবনের শুরুর গল্প জানতে চাই?
২০০৮ সালে ৫৯৫ টাকার ক্রিস্টাল কিনেছিলাম, ব্যাগ বানানোর জন্য। সাংসারিক কাজের পর যেটুকু অবসর সময় ছিল আমার, সেই সময়টুকুতে আমি ব্যাগ বানাতাম। তখন রঙ-বেরঙের পুঁথি এবং ক্রিস্টালের ব্যাগ বেশ জনপ্রিয় ছিলো। আমি যখন বাচ্চার স্কুলে যেতাম তখন হাতে করে নিয়ে যেতাম ব্যাগগুলো। সবাই বেশ পছন্দ করত কারণ হাতের তৈরি ব্যাগ এবং বিভিন্ন সুন্দর শেপের ছিল। এর মধ্যে এই ব্যাগগুলো এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো যে, আমার একার হাতে তৈরি করে সরবরাহ করতে বেশ মুশকিল হয়ে যেতো। তাই পরবর্তীতে ১০জন নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমার বাসায় এনে তাদের দিয়ে কাজ করাই।
পরবর্তীতে ব্যাগের সাথে গলার, কানের এবং হাতের জুয়েলারি তৈরি করা শুরু করি। দেখলাম জুয়েলারিগুলো সবাই খুব পছন্দ করা শুরু করলো। তখন প্রায় ১ লাখ ৭২ হাজার টাকার মতো বিক্রি করি।
তবে সে সময় কিছুটা বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলাম। অনেকেই কূটক্তি করতো আমাকে। পিছনে অনেকেই বলতো ওই ‘ব্যাগওয়ালী’ যায়। এতে আমি মোটেও কষ্ট পেতাম না। কারণ আমি জানতাম আমি ভালোভাবে কাজ করে গেলে একদিন সফলতা আসবেই।
পরবর্তীতে দেখলাম অনেকেই এই ব্যাগগুলো নিয়ে কাজ করা শুরু করলো। তখন আমি চিন্তা করলাম যে, আমার নতুন কিছু করতে হবে। সেই চিন্তা ভাবনা থেকেই একদিন আমি ৪ হাজার ৯শ’ টাকার কাপড় কিনে ফেললাম। কাপড় কিনে খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কাপড়গুলো বিক্রি হবে কি-না তা নিয়ে আমি বেশ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। তখন আমার পরিবার থেকে বেশ সাপোর্ট পাই আমি। আমার হাজব্যেন্ড আমাকে বলেন ‘যদি কাপড় বিক্রি না হয় তাহলে তুমি নিজে ব্যবহার করে ফেলো তবুও টেনশন করো না’। কিছুদিনের মধ্যেই আমার সেই কাপড়গুলো বিক্রি হয়ে গিয়েছিলো।
যখন কাজ করতে গিয়েছি তখনই মানুষের অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছি। যখন কাপড় বিক্রি করতাম তখন অনেকেই সামনাসামনি কিছু না বললেও পেছন থেকে বলতো ওই দেখ ‘কাপড়ওয়ালী’। মাঝে মধ্যে খারাপ লাগতো। তবে এসব কথায় আমি দমে যাইনি কখনো। আমি ধৈর্য্য ধরেছি আর অপেক্ষা করেছি সুসময়ের। পরবর্তীতে ২০১২ সালে আমি একটা শোরুম নেই। ‘এস এস হ্যান্ডিক্র্যাফটস’ নামে আমার শোরুম নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। তখনও আশেপাশের অনেকে কূটক্তি করেছে। এমনও অনেকে বলেছে ‘মেয়ে মানুষ আবার শোরুম চালাবে’। আমি কখনো দমে যাইনি এসব কথায়। আমি সবসময় নিজেকে শক্ত রেখেছি। এক সময় যারা আমাকে কূটক্তি করতো তারাই আবার আমার সফলতা দেখে আমার প্রশংসা করতে শুরু করে।
কাজু বাদাম নিয়ে কেনো কাজ করছেন?
আমার এসএস হ্যান্ডিক্র্যাফটস এর যাত্রা শুরু ২০০৬ থেকে তখন থেকেই কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনাকালীন সময়ে আমার শোরুম বন্ধ হয়ে যায়। তখন চিন্তা করলাম এই সময়ে পার্বত্য এলাকায় উৎপাদিত পণ্য নিয়ে কাজ করার। তারপর যাত্রা শুরু করি দেশীয় কাজুবাদাম নিয়ে। যদিও অনেকদিন আগে থেকেই চিন্তা ছিলো কৃষিপণ্য নিয়ে কাজ করার।
শুধুমাত্র অনলাইনেই সাড়ে এগারো লক্ষ টাকার কাজু বাদাম বিক্রি করেছেন, কিভাবে?
করোনাকালীন সময়ে যখন কাজুবাদাম নিয়ে কাজ শুরু করি তখন অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় নি যে, আমাদের দেশেও কাজুবাদাম উৎপাদন হয়। সেজন্য কাজুবাদাম বাগানে গিয়ে গাছে কাজুবাদামসহ ছবি তুলে এবং ভিডিও করে পোস্ট করতে থাকি। এতে করে মানুষের আগ্রহ জন্মায় এবং অর্ডার করে।
চ্যালেঞ্জ ছিলো কি রকম?
প্রথম প্রথম লোকজন বিশ্বাসই করতোনা যে, আমাদের দেশে কাজুবাদাম উৎপাদন হয়। তাদের ধারণা পাল্টানো বা বুঝানোটাই ছিলো চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও এলাকায় কাজুবাদাম প্যাকেজিং করার ম্যাটিরিয়াল পাওয়া যেতো না। তবে চ্যালেঞ্জের চেয়ে আমার আত্মবিশ্বাস ছিলো বেশি।
প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতায় পড়েছেন কি?
সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিলো কুরিয়ার সার্ভিস। অনেক কাস্টমারই পণ্য হোম ডেলিভারি চাইতো, কিন্তু কুরিয়ার সার্ভিসগুলো তখন হোম ডেলিভারি দিতে চাইতো না। এছাড়া তেমন প্রতিবন্ধকতা ছিলো না।
কাজু বাদামের পাশাপাশি বর্তমানে আর কি নিয়ে কাজ করছেন?
পার্বত্য এলাকায় উৎপণ্য বিন্নী ধানের চাল (লাল, কালো, সাদা) নিয়ে। এছাড়াও পাহাড়ি এলাকার তেতুল, মসলা ইত্যাদি। তবে আমার এস এস হ্যান্ডিক্র্যাফটস নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে আরও বেশকিছু হাতের কাজের আইটেম আছে।
অনুপ্রেরণায় কে ছিলেন?
আমার সব সময় পাশে থেকে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা এবং সাহস যুগিয়েছেন আমার স্বামী। তিনি সব সময় আমাকে সাপোর্ট করতেন। আমার কাজে সাহায্য করতেন।
কাজু বাদাম নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
ইতোমধ্যেই কাজুবাদামের প্রায় ১২টি রেসিপি তৈরি করেছি। আরও তৈরি করার চেষ্টা করছি ও এসব রেসিপি নিয়ে একটা কাজুবাদাম রেসিপি বই বের করার পরিকল্পনা আছে। যেনো মানুষ এই কাজু বাদাম ও এর রেসিপি সম্পর্কে জানতে পারে। এছাড়াও কাজুবাদামের একটি নারীবান্ধব শিল্প প্রতিষ্ঠা করা। কাজুবাদামের বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে গবেষণা এবং তা ব্যবহারের বার্তা জনগনের নিকট পৌঁছাতে কাজ করে যাবো।
সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?
তরুণ উদ্যোক্তাদের বলবো, কি নিয়ে কাজ করবেন প্রথমেই তা সনাক্ত করুন। যে কোন একটা বিষয়ে ফোকাস করুন এবং সেই বিষয়ে পড়াশোনা করুন, জানুন। তারপর কাজ শুরু করুন। পরিশ্রম আর কাজের প্রতি একনিষ্ঠা থাকলে সফল হবেন।
মন্তব্য করুন