ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ খেলাপির সুদ মওকুফ প্রসঙ্গে
জাতীয় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর চাষি কবিতায় কৃষকদের বলেছেন ‘‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা, দেশ মাতার-ই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা’। তিনি ফসল ফলানোর জন্য কাব্যিক ভাষায় কৃষককে উৎসাহ উদ্দীপনা যুগিয়ে গেছেন। কৃষকরা সবারই সে অন্ন জোগায়, নিজের সুখ না চেয়ে রৌদ্রে ঘামে, বৃষ্টিতে ভিজে ফসল ফলান।
এজন্য কৃষকদের আমার দেশের মাটির ছেলের সংগে তুলনা করে চূর্ণ শিরে সবার অহংকার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কবির এই কবিতার সংগে বর্তমানে তারতম্যের ব্যবধান বহুগুণ। কারণ কৃষিতে উৎপাদন ব্যয়ের সংগে বাজারে কৃষি পণ্যের দাম ও শ্রম বাজারের কোন সমতা নাই। একজন কৃষকের একমণ ধান ফলাতে খরচ হয় প্রায় ৬শত টাকা। বাজারে বিক্রি হয় ৯শত থেকে ১ হাজার টাকা।
একজন শ্রমিকের মজুরি ৫ শত টাকা। সার ও কীটনাশকের মূল্যের তারতম্য অনেক বেশি। কৃষি পণ্য বাজারে নিলে ব্যবসায়ীরা অর্ধেক দামে কিনে; দ্বিগুন দামে বিক্রি করে। দেশের প্রান্তিক চাষিরা সরকারি খাদ্য গুদামে সরাসরি তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারে না। এক শ্রেণির দাদন ফঁড়িয়া ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরকারি খাদ্য গুদামে ধান, গম কিনে মজুদ করা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে সরকারি গুদামে মজুদকৃত গম, ধান ও চালের মাননির্ণয় নিয়েও নানান প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। খাদ্য গুদামে খাদ্য শস্য মজুদ করার অন্যতম লক্ষ্য উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগসহ নানামুখী সমস্যায় দেশের খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলা করা। আপসোস, আমাদের দেশের একশ্রেণির জনপ্রতিনিধি আর খাদ্য বিভাগের অসাধু কিছু কর্মকর্তার যোগসাজসে গোটা দেশ ও জাতির নিমিত্তে মজুদকৃত খাদ্য শস্য ভবিষ্যতে গো খাদ্যে পরিণত হয়।
দেশের পনেরটি চিনি কলের উৎপাদিত চিনি সঠিক সময়ে বিক্রি হয় না। সুগার মিলের সংগে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের বেতন-ভাতাদি নিতে পারেন না। দেশে লাখ লাখ টন চিনি মজুদ থাকার পরও সরকার বিদেশ থেকে নিম্নমানের চিনি আমদানি করে। যে কারণে দেশে কয়েকটি সুগার মিল বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের জনসাধারণ দেশের পণ্য সামগ্রী নিতে চান, খেতে চান, ব্যবহার করতে চান। কিন্তু দেশ পরিচালনার সংগে জড়িত ব্যক্তিদের সৎ ইচ্ছার অভাবে দেশের কল-কারখানার উৎপাদিত পণ্য জনসাধারণ সহজমূল্যে হাতের নাগালে পান না।
দেশের প্রান্তিক চাষিদের সার, তেল ও বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়ার নামে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত প্রান্তিক চাষিরা ওই সুবিধা কখনো পাইনি। একশ্রেণীর রাজনৈতিক ব্যক্তি, সরকারি আমলা ও কিছু জমির মালিক নামে-বেনামে সেই ভর্তুকির টাকা নিয়ে লুটেপুটে খাচ্ছেন। এক্ষেত্রে প্রান্তিক চাষিরা গঞ্জনা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। প্রান্তিক চাষিদের ব্যাংকে কৃষি ঋণ নিতে দালাল চক্রের সহযোগিতা লাগে। ঘুষ না দিলে সঠিক সময়ে গ্রামের কোন সহজ সরল কৃষক ব্যাংকে ঋণ সুবিধা পাই না।
অপরদিকে যেসমস্ত কৃষক ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না; তাদের নামে মামলা হামলা হচ্ছে। কিন্তু দেশের হলমার্ক কেলেংকারি, ডেসটিনি, ব্যাংক লুট, ব্যাংক ডাকাতির মত বড় বড় ঋণ খেলাপি থাকলেও তাদের তুলনায় গ্রামের সহজ সরল কৃষকদের স্বল্প সংখ্যক ঋণ আদায়ের জন্য কত যাতনাই সহ্য করতে হয়। সাধারণত একজন ক্ষুদ্র কৃষক কোন ব্যাংক থেকে ২০১১-২০১২ সালের দিকে ব্যাংক থেকে ‘জাগো নারী ১৫ হাজার টাকা ঋণ ও উন্মেষ ৩০ হাজার টাকা ঋণ’ নেয়।
তাদের মধ্যে অনেক গ্রাহক উক্ত ঋণের ১০-১৫ হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধ করে খেলাপি বনে গেছেন। বর্তমানে সেইসব খেলাপি ঋণ সুদে আসলে প্রায় তিন থেকে চারগুণ টাকায় পরিণত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক পাওনা ঋণের টাকা পরিশোধের নোটিস দিচ্ছে। সেই নোটিশ হাতে পাওয়ার পর ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহিতার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে।
আধুনিক ক্ষুদ্রঋণ সাধারণত ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে তাদের বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হয়। জাতিসংঘ ২০০৫ কে ক্ষুদ্রঋণের আন্তর্জাতিক বছর ঘোষণা করেছে। বিগত ২০২৩ সালের ব্যাংকের পল্লী ও কৃষিঋণ সুদ হার ৯.৭০% নিধারণ করা হয়েছে। সেই হার কৃষি ঋণের সুদ হার কমিনে আনা দরকার। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ব্যাংক কর্মকর্তারাও মনে করেন একজন গরীব কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা আজ থেকে ১০ বছর আগে ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে উক্ত ঋণের ১০-১৫ হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধের পর খেলাপি হয়েছেন।
বর্তমানে ওই ঋণ গ্রহীতার সুদ ও আসল মিলে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণের বকেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ তার উপদেষ্টা পরিষদমন্ডলী এবং ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকবৃন্দ যদি সদয় হয়ে দেশের প্রান্তিক ক্ষুদ্রঋণ খেলাপিদের বকেয়া মওকুফ করতে পারেন। যদি এরকম কোন সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় তবে একদিকে ক্ষুদ্র ঋণ খেলাপিরা সুদ থেকে মুক্ত হবে এবং ব্যাংকের বকেয়া ঋণ পরিশোধ হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের বকেয়া ঋণ আদায় অনেকাংশে বাড়বে।
আরও পড়ুনবাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি। ২০০৯ সালের কৃষি শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট পরিবার/খানা ৩ কোটি ৫৫ লাখ ৫২ হাজার ২৯৬টি এবং ২০২২ সালের বিবিএস অনুযায়ী মোট কৃষি পরিবার/খানা ১ কোটি ৬৮ লাখ ৮১ হাজার ৭৫৭টি এবং কৃষি বহির্ভূত পরিবার/খানা ১ কোটি ৮৬ লাখ ৭০ হাজার ৫৩৯টি। বর্তমান বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২ কোটি ৪৬ লক্ষ ৯৩ হাজার জনশক্তি কৃষি খাতে নিয়োজিত।
এটি মোট শ্রমশক্তির ৪০.৬ ভাগ যোগান দিয়ে থাকে এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান ১৪.১০ শতাংশ। বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ২ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার একর বা ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। দেশের আবাদযোগ্য জমি ৮৮ লাখ ২৯ হাজার ২৬৬ হেক্টর এবং আবাদযোগ্য অনাবাদি জমির পরিমাণ ২ লাখ ২৫ হাজার ৫৫১ একর বা ৯১ হাজার ২৭৭ হেক্টর। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মোট ধানি জমির ৮১ শতাংশে উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ হচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা ছিল ৭৩ শতাংশ। দেশের মোট আবাদি জমির শতকরা ৮০ ভাগ জমিতে ধানের চাষ হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে কৃষি উৎপাদনের জন্য ফসলি জমি ৮৮.২৯ লক্ষ হেক্টর। এছাড়া নদী এলাকা ৮.২৩৬ বর্গ কিলোমিটার ও বনাঞ্চলের আয়তন ১৯.৭১০ বর্গ কিলোমিটার। দেশে খাদ্য শস্যের চাহিদা ২৪৫.২০ লাখ মে.টন (প্রতিদিন জন প্রতি ৪৫৩.৫৩ গ্রাম হিসাবে)। ২০২১-২০২২ তথ্যমতে কৃষি খাতে জিডিপি’র অবদান ১১.৫২%। বুয়েট স্ট্যাডি রিপোর্ট/২০০৮ তথ্য মতে; কৃষি থেকে ২২% জিডিপি এবং ৬০% মানুষের জীবিকা নির্বাহ করে। কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশের গ্রাম অঞ্চলে জনসংখ্যার ৮৪% কৃষির উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে কৃষি থেকে আমাদের জিডিপি ৩২%। এছাড়া শতকরা ৬৩% লোক কৃষি শ্রমের সংগে কোন ভাবে সম্পৃক্ত আছে। এর মধ্যে ৫৭% চাকরিজীবি যুক্ত রয়েছে।
বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভরশীল উন্নয়নশীল দেশ। ১৯৯০ সাল থেকে শুরু করে ২০০০-২০০১ অর্থ বছর থেকে খাদ্য শস্যে আমরা কিছুটা স্বয়ংসম্পুর্ণ হয়েছি। পৃথিবীতে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে কৃষি ক্ষেত্রে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে কৃষি উৎপাদন কমে যাবে। কৃষিবিদদের তথ্য মতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে মোট কৃষি আবাদযোগ্য জমির শতকরা ১% হারে হ্রাস পাচ্ছে। কৃষি নির্ভরশীল বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই তথ্য ভবিষ্যতের জন্য আশংকাজনক।
ভাল ফলন পেয়েও বাজারে দাম না পেয়ে চাষিদের মুখে হাসি নাই। কৃষি জমি এখন থেকে রক্ষা করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে খাদ্য সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক পরিবেশের বিরূপ পরিবর্তনের ফলে কৃষি সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে মানুষের জীবন ও জীবিকা ক্রমাগত হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কৃষিশুমারির তথ্য মতে, গত এক দশকে গড়ে প্রতিবছর কৃষিজমি কমছে ০.২১ শতাংশ।
দেশের কৃষিজমি যেমন অন্য খাতে যাচ্ছে, কৃষির ওপর নির্ভশীল পরিবারও বাড়ছে। মানুষের মৌল মানবিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম চিকিৎসা সেবা। গ্রাম-গঞ্জের প্রান্তিক চাষিসহ আপামর জনসাধারণ সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চিকিৎসা বিভাগে চরম দূর্নীতি ও অনিয়ম ঢুকে পড়েছে। দেশের পল্লী অঞ্চলসহ জেলা শহরের অনেক হাসপাতালে এখনো চিকিৎসক সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংকট বিরাজমান। তথ্যপ্রযুক্তি যেভাবে অগ্রসর তাতে জনগণের চোখ ফাঁকি দেবার সুযোগ নাই।
এম এ বাসেত
লেখক : সাংবাদিক, কবি ও উদ্যোক্তা
01718-281367
মন্তব্য করুন