জৌলুস হারাচ্ছে নদীকেন্দ্রিক জীবন : নৌ-রুট বন্ধ চলনবিলের ২৬টি নদ-নদীর অধিকাংশই মৃতপ্রায়
পাবনা প্রতিনিধি : পৌষ মাস আসতে না আসতেই শুকিয়ে গেছে পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জের চলনবিল অধ্যুষিত উপজেলাগুলোর মধ্যদিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীগুলো। এ এলাকার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত ২৬টি নদ-নদীর মধ্যে ২১টির অবস্থাই অত্যন্ত করুণ। কিছু নদীর অস্তিত্বই নেই।
নদ-নদীগুলো দ্রুত শুকিয়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ নৌ-রুট। দু’একটি নৌ-রুট এখনও সচল থাকলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেগুলোও অচল হয়ে পড়বে। বিলগুলোর সাথে নদ-নদীর সংযোগ খালগুলো শুকিয়ে গেছে অগ্রহায়ণ মাসেই। আত্রাই রিভার ড্রেজিং প্রজেক্টের আওতায় কিছু নদী পথ খনন করা হলেও তা খুব বেশি কাজে আসছে না।
চলনবিল অঞ্চলের নদ-নদী খাল বিল দ্রুত শুকিয়ে যাওয়ায় এক সময়ের চলন্তবিল খ্যাত ‘চলনবিল’ পরিণত হচ্ছে মরা বিলে। অগ্রহায়ণ থেকে চৈত্র এ পাঁচ মাস নদীগুলো শুকনো থাকে। এসময় অনেক নদীতেই বিভিন্ন ফসলের আবাদ হয়। নাব্যতা সংকটের কারণে সেচ কার্য ব্যাহত হচ্ছে। বিলুপ্ত হচ্ছে দেশি মৎস্য সম্পদ। এ এলাকার ব্যবসা বাণিজ্যেও পড়ছে এর পপ্রাব। দখল দূষণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে নদ নদীগুলো।
জানা গেছে, ভারেেতর জলপাইগুড়ির পাহাড় থেকে উৎপন্ন হওয়া আত্রাই ও গুড় নদী রাজশাহীতে এসে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর একটি শাখা কয়রাবাড়ি, নন্দনালী ও আত্রাই হয়ে আত্রাই ঘাটের এক মাইল নিম্ন হতে ‘গুড়’ নামে সিংড়া, একান্ন বিঘা,যোগেন্দ্রনগর ও কালাকান্দরের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁচকৈড় ত্রিমোহনায় নন্দকূজার সাথে মিশেছে। এদের মিলিত স্রোত গুমানী নামে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে বড়াল নদীর সাথে মিশেছে।
১৭৮৭ সালে তিস্তার সাথে আত্রাই নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জলপাইগুড়ির উত্তর পশ্চিম সীমান্ত থেকে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, নিমগাছী, তাড়াশ, চাটমোহরের হান্ডিয়াল হয়ে অষ্টমনিষার কাছে বড়াল নদীতে মিশেছে। ১৩০৪ সালে ভূমিকম্পে নদীটির কয়েক জায়গা মরে যায়। করতোয়ার নিম্নাংশ আত্রাই ও ফুলঝোড় নামে পরিচিত। বড়াল নদী পদ্মার চারঘাট মোহনা থেকে নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম হয়ে চাটমোহরের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে গুমানীর সাথে মিশে বড়াল নামেই ভাঙ্গুড়া ফরিদপুর বাঘাবাড়ি হয়ে হুড়াসাগরের সাথে মিশে নাকালিয়া এলাকায় গিয়ে যমুনার সাথে মিশেছে।
আরও পড়ুনউনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝিতে ও নদীটি স্রোতস্বীনি থাকলেও একেবারে শেষের দিকে রাজশাহী থেকে নূরনগর পর্যন্ত নদীটির অনেক স্থানে ক্রসবাঁধ দেয়ায় এ নদীটি এখন মৃতবস্থায় পড়ে আছে। এ নদী উদ্ধারে বড়াল রক্ষা কমিটি দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। ফলশ্রুতিতে চাটমোহর নতুন বাজার, বোঁথর ঘাট ও রামনগরের ঘাটের তিনটি ক্রসবাঁধ অপসারণ করা হলেও এখনও পদ্মার সাথে যমুনার সংযোগ ঘটানো সম্ভব হয়নি। নূরনগর থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত বর্ষায় কিছুদিনের জন্য প্রাণ ফিরে পায় নদীটি।
চেঁচুয়া নদী ধারাবারিষার দক্ষিণপাশ দিয়ে চতরার বিল, জোড়দহ, আফরার বিল, খলিশাগাড়ি বিল ও কিনু সরকারের ধর হয়ে চরসেনগ্রামের পশ্চিমে গুমানী নদীর সাথে মিশেছে। এ নদীটিও প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। চিকনাই নদী চাটমোহরের মূলগ্রাম ফৈলজানা হয়ে ফরিদপুরের ডেমরার কাছে বড়াল নদীতে মিশেছে। ডেমরা এলাকায় স্লুইজগেট থাকায় ফরিদপুর থেকে নদীটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বর্ষা মৌসুমে মাস চারেক এ নদীতে পানি থাকলেও বাকী ৮ মাস পানি শূণ্য থাকে নদীটি। এগুলো ছাড়াও বানগঙ্গা, তুলশী নদী, ভাদাই নদী, মরা আত্রাই নদীর অবস্থা অত্যন্ত করুণ।
শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিল এলাকার নদ নদী খাল বিল আগের জৌলুস হারাচ্ছে। মৎস্য ভান্ডার খ্যাত চলনবিল এলাকার হাট বাজারে দেশি মাছের চরম সংকট চলছে। জলপথে পণ্য পরিবহনে খরচ কম হলেও নাব্যতা সংকটের কারণে বছরের অধিকাংশ সময় বেশি ব্যয়ে সড়ক পথে ব্যবসায়ীদের পণ্য পরিবহন করতে হয়। ক্রেতারা বিভিন্ন হাট বাজার থেকে পণ্য কিনে নৌপথে বাড়িতে নিতে পারছেন না। বেকার হয়ে পড়েন হাজার হাজার মৎসজীবী।
মন্তব্য করুন